ফ্রান্সের লিয়ঁ শহরের চিত্রকর আঁতোয়া লুমিয়ের চিত্রকর্মে আর্থিক সুবিধা করতে পারছিলেন না। ফলে হুট করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন ছবি আঁকা ছেড়ে দেবেন। উপার্জন করাটা খুব বেশি জরুরী হয়ে পড়ছিল তাঁর। ফলে মনের গহীনে লালিত হওয়া আর্টের পথ ছেড়ে দিয়ে ফটোগ্রাফিক মাল মশলা তৈরি এবং এর সরবরাহ দেয়ার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান খুলে বসলেন। রং তুলির শিল্পী মনের অজান্তে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বিস্ময়কর শিল্প মাধ্যম যাকে সপ্তম আর্টের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এবং যাকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ নামে সম্মানিত করা হয়েছে- সেই চলচ্চিত্র আবিষ্কারের পথটা সহজ ও সরল করে দিলেন এভাবেই। আজকের যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী এই শিল্প-মাধ্যমের আবিষ্কারের সঙ্গে ফ্রান্সের আঁতোয়া লুমিয়ের (১৮৪০-১৯১১) নাম কখনো উচ্চারিত হয় না বরং উচ্চারিত হয় তাঁর দুই সন্তান অগুস্ত লুমিয়ের (১৮৬২-১৯৫৪) এবং লুই লুমিয়েরের (১৮৬৪-১৯৪৮) নাম। কিন্তু আঁতোয়া’র মত পিতা না পেলে অগুস্ত এবং লুইয়ের সিনেমাটোগ্রাফের আবিস্কার হয়ত অনিশ্চিত হয়ে পড়তো আর স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর মানুষ চলচ্চিত্র শিল্পের স্বাদ আরো বিলম্বে পেতো।
আঁতোয়া লুমিয়ের রং-তুলি ছেড়েছিলেন এটা সত্য কিন্তু মনের মধ্যে প্রকৃতির যে সৌন্দর্য তাঁকে আলোড়িত করতো, সেই সৌন্দর্যের স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য তিনি ক্যামেরা হাতে নিয়েছিলেন এবং দীর্ঘ সাধনায় খ্যাতনামা ফটোগ্রাফারের স্তরে উন্নীত করলেন। আর অবিরাম পরিশ্রমে নিজের ফটোগ্রাফিক মান মশলা তৈরির প্রতিষ্ঠানটির আকার বড় হয়ে লাগলো। সে সময়ে প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফটোগ্রাফিক কারখানা। সবচেয়ে বড় কারখানা আমেরিকার নিউইয়র্কের জর্জ ইস্টম্যানের ইস্টম্যান কোডাক কোম্পানির পরেই ছিল ের স্থান। আঁতোয়া লুমিয়ের’র দুই সন্তান আগুস্ত এবং লুই পিতার সঙ্গে মগ্ন হয়ে কাজ করতে শুরু করলেন নতু সৃষ্টির উদ্দীপনায়। বড় জন মুলত ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করতেন আর ছোট জন পদার্থবিদ্যায় আবেশিত লুই নতুন আবিষ্কারের চিন্তায় মগ্ন রইলেন সারা সময়। তবে দুজনই ছিলেন একে অপরের পরিপূরক।
চলচ্চিত্র আবিষ্কারের শুরুর মাহেন্দ্রক্ষণটি ১৮৯৪ সালের গ্রীষ্মকালে। ইতোমধ্যে টমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭-১৯৩১) ও ডব্লিউ কে এল ডিক্সন (১৮৬০-১৯৩৫) ১৮৮৮ সালে কিনোটোস্কোপ আবিস্কার করেছেন। পঞ্চাশ ফুট দৈর্ঘ্যের চলমান ছবি এই যন্ত্রের মাধ্যমে দেখা যেতো। বিশাল আকৃতির এই যন্ত্রটিতে কেবলমাত্র একজন এর ছবি দেখতে পেতেন। ১৮৯৪ গ্রীষ্মে টমাস আলভা এডিসন প্যারিসে কিনোটোস্কোপ-এর প্রদশর্নীতে আঁতোয়া লুমিয়েরকে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রথমবারের মত তিনি কিনোটোস্কোপ প্রত্যক্ষ করে নিজ শহর লিয়ঁতে ফিরে এসে দুই সন্তানকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে শুধু বলেছিলেন, ‘তোমরা এর থেকে ভালো কিছু করার চেষ্টা কর। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি’।
পিতার অনুপ্রেরণা গভীর উদ্দীপনার জন্ম দিল অগুস্ত ও লুই লুমিয়ের’র মনে। বিশেষ করে লুই যিনি পদার্থবিদ্যা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে ভালোবাসতেন। চলমান আলোকচিত্র গ্রহণের উপযোগী
ক্যামেরা আবিষ্কারের নেশায় দীর্ঘ গবেষণা ও পরিশ্রমের পর তিনি এক ধরণের ক্যামেরা ও প্রোজেক্টর যন্ত্রের আবিষ্কারে সফল হন। প্রখ্যাত সমালোচক ও চলচ্চিত্রের ঐতিহাসিক জর্জ সাঁসুল বলেছেন, লুই লুমিয়ের ডিটেলের প্রতি এত গভীর মনোযোগ দিয়েছিলেন বলেই প্রকৃত অর্থেই তাঁকে সত্যিকারের চলচ্চিত্রের প্রথম স্রষ্টা বলা য়ায। অগুস্ত লুমিয়েরও ছোট ভাইয়ের কৃতিত্ব বিন্যের সঙ্গে স্বীকার করে উল্লেখ করেছেন, তাঁর ভাই এক রাতের মধ্যে চলচ্চিত্র আবিষ্কার করেন। আর সেই রাতে সৃষ্টির বেদনায় লুই মাথার যন্ত্রণা এবং নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখেন খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন।
তবে এটা স্বীকার্য যে, চলচ্চিত্রের মত একটা জটিল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হঠাৎ করে করো মাথায় এক রাতে আসেনি। বরং দীর্ঘ হাজার হাজার বছরে মানুষের চলমান দৃশ্যের স্থায়ী প্রতিফলনে যে স্বপ্ন ও আগ্রহ, এর ধারাবাহিকতার একটা চূড়ান্ত মুহূর্ত হতে পারে লুই লুমিয়ের’র অস্থির রাত।
‘সিনেমা’ শব্দটির উৎপত্তিগত বিষয়টি লক্ষ্য করলে আমাদের ফিরে যেতে হয় অনেক পেছনে। গ্রীক ‘কিনেমা’ শব্দটি থেকে ‘সিনেমা’ শব্দটি এসেছে; যার অর্থ ‘গতি’। আমরা যদি স্পেনের প্রাচীন গুহা আলতামিরায় ফিরে যায় তাহলে দেখি, একটি বাইসন দৌড়াচ্ছে; যার পায়ের সংখ্যা ছয়টি। দৌড়ানোর সময় নিশ্চয় আমাদের মনে হয় কোন প্রাণীর পায়ের সংখ্যা বেড়ে গেছে। হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সেই গুহাশিল্পী হয়ত বাইসনের সেই গতির রূপটাই ধরতে চেয়েছিলেন।
যুগে যুগে আমরা গুহাচিত্র, ধোঁয়া-সংকেত (Smoke-Signal), চীনা ছায়া নাটক (Shadow-Play) বা মধ্যযুগের ম্যাজিক-লন্ঠনের (Magic-Lantern) মাঝে দেখি মানুষ কীভাবে ঘটমান গতিকে রূপ দিতে চেয়েছেন। কাঁচ ঘষে ছোট জিনিস বড় করে দেখা, অর্থাৎ ‘লেন্স’ আবিষ্কার, মানব সভ্যতার পুরনো এক আবিষ্কার। তবে ১৬৪০ সালে এথেন্সিয়াস কারচার তাঁর ম্যাজিক-লন্ঠনে যীশু’র জীবনের ঘটনাসমূহকে যখন একটা চলমান রূপ দেয়ার চেষ্টা নিয়েছিলেন, সেটাকে ঘটমান গতিকে ধরার একটা উল্লেখযোগ্য প্রয়াস বলতে হবে। আর এই ঘটমান গতিকে ধরাই হচ্ছে চলচ্চিত্র শিল্পের মূলকথা।
চলচ্চিত্র বিজ্ঞানের মূলসূত্র, ‘অবিরত দৃষ্টিতত্ত্ব’ (Persistence of Vision), প্রাচীনকাল থেকেই বিজ্ঞানীদের এই বিষয়টি ভাবিয়েছে। সহজভাবে বললে ‘অবিরত দৃষ্টিতত্ত্ব’ হচ্ছে- আমরা যখন একটা জিনিস দেখি এবং তা থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্য আরেকটা ফিনিস দেখি; এ দুয়ের মাঝে আমাদের চোখে খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও(সেকেন্ডের ভগ্নাংশ) আগের দেখা চিত্রটার রেশ লেগে থাকে। চলচ্চিত্রে পর পর সাজানো একটা শট থেকে আরেকটা শটে দর্শককে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃষ্টি বিজ্ঞানগত ভিত্তিটা হচ্ছে- এই ‘অবিরত দৃষ্টিতত্ত্ব’। যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে মানুষের জ্ঞান বাড়াতে সাহায্য করেছেন। অ্যারিষ্টটাল ও আর্কিমিডিসের আলোকবিদ্যা, ইউক্লিডের আলোর গতির তত্ত্ব পেরিয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ক্যামেরা ‘অবসকিউরা’-কে গ্রহণ করে, পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীদের লেন্সের নানা গবেষণা এবং নিসেফোর নিপসের ফটোগ্রাফিক ইমেজকে ধারণ করে আজকের ফিল্ম ও চলচ্চিত্রের বিকাশের পথ সহজতর হয়। ফলে আজকের চলচ্চিত্রের আবিষ্কারের পথ হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের চিন্তা ও সাধনার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য ঘটনা জরিয়ে রয়েছে। তারপরও যে সব সৃষ্টিশীল প্রাণে প্রত্যক্ষভাবে একে বর্তমান রূপ দিয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলতে হয়, লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের ক্যামেরা, ইস্টম্যানের সংবেদনশীল ফিল্ম ও ম্যারের আবিস্কৃত প্রোজেক্টরের সংমিশ্রণেই আজকের চলচ্চিত্রের জন্ম। এর আগে প্রতিভাবান ক্যামেরাম্যান এতিয়েন মারে ফটোগান নামে রিপিট শট রাইফেলের মতো এক ধরনের ক্যামেরা আবিস্কার করেছিলেন যা দিয়ে পর পর গুলি ছোঁড়ার ভঙ্গিমায় এক সঙ্গে অনেকগুলা ফ্রেম শুট করা সম্ভাব ছিল। সে ক্যামেরা এখন আর ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু চলচ্চিত্রের ‘শ্যুটিং’ শব্দটার উৎপত্তি ওখান থেকেই।
লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় তাদের প্রথম চলচ্চিত্রটি শ্যুট করেছিলেন ১৮৯৫ সালের ১৯ মার্চ। ১৫ মার্চ থেকে ২০ মার্চের মধ্যে তারা তাদের প্রথম চলচ্চিত্রটির সব কাজ শেষ করেন। ছবিটির নাম ওয়ার্কার্স লিভিং দ্য লুমিয়ের ফ্যাক্টরি। ওই দিনের যেহেতু ১৯ তারিখে ছাড়া প্রতিদিন বৃষ্টি হয়েছিলো সে জন্য ধারণা করা হয় সেই দিনই পৃথিবীর ইতিহাসে লুমিয়েরদের দ্বারা প্রথম ছবির শ্যুটিং হয়ছিল। মাত্র ৪৬ সেকেন্ডের ছবিটিতে দেখা যায় লুমিয়েরদের কারখানা থেকে শ্রমিকরা বের হচ্ছেন যাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী শ্রমিক। তারা যখন কারখানা থেকে বের হচ্ছিলেন তখন কেউ-ই ক্যামেরার দিকে তাকাননি। ফলে ধারণা করা হয় তারা শ্যুটিং এর বিষয়টা জানতেন। শ্রমিক ছাড়াও ছবিটিতে দেখা যায় একটা কুকুর, একটা বাইসাইকেল এবং দুটো ঘোড়া। ফলে স্বাভাবতই বলা যায়, চলচ্চিত্রের প্রথম চরিত্র হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী, কুকুর এবং ঘোড়া। পরবর্তীতে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় একক শর্টের মোট ১৪২৫টা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন; যার কোনটিরই দৈর্ঘ্য এক মিনিটের ঊর্ধ্বে নয়। তাদের ছবিগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্যারিসের গ্র্যান্ড ক্যাফেতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম বারের মত অগুস্ত লুমিয়ের কুড়ি মিনিটের অনুষ্ঠানে তাঁদের নির্মিত দশটি চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী করেন। এরপর তারা প্যারিসের একটা প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। প্রথম কয়েকদিন দর্শকদের বিশেষ কোন ভিড় হয়নি, তারপর ধীরে ধীরে এটা এমনই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে যে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার ঢেউ ছড়িয়ে গোটা দুনিয়া জুড়ে।
লুমিয়েররা যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও পাকা ব্যবসায়ীর মতো আগের বেশ কয়েকটি ক্যামেরা ও প্রোজেক্টর তৈরি করে রেখেছিলেন। তাদের বিশ্বাসী কিছু লোককে ক্যামেরাম্যান ও প্রোজেক্টর অপারেটরের কাজও শিখিয়ে রেখেছিলেন। এসব ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোকদের মাধ্যমে লুমিয়েররা তাদের আবিষ্কৃত চলচ্চিত্র পাঠাতে লাগলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
ভারতবর্ষে লুমিয়েরদের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হলো বোম্বাই শহরে ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই। যে কয়েকটি স্বল্প দৈর্ঘ্যর ছবি তখন দেখানো হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
কোলকাতায় ছবিগুলা দেখানো হয় পরের বছর অর্থাৎ ১৮৯৭ সালে। ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল বেডফোর্ড সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি ঢাকায় ক্রাউন থিয়েটারে প্রথম চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী করে।
লুমিয়েররা আর্ক- লাইট প্রজেক্টরে তাঁদের ছবি দেখতেন। প্রতি সেকেন্ডে ১৬ ফ্রেম করে ছবি পর্দায় পড়তো। বর্তমানে প্রতি সেকেন্ডে ২৪ ফ্রেম করে পড়ে থাকে। ফলে তাদের ছবিগুলো দেখলে মনে হয় চরিত্ররা ছুটোছুটি করছে অর্থাৎ ফাস্ট মোশন হচ্ছে।
লুমিয়েরদের ১৪২৫টি ছবির মাধ্যমে সেই সময়ের ফ্রান্সের একটি চিত্র পাওয়া যায়। এর আগে ফটোগ্রাফি আবিস্কার হয়েছে ফলে স্থিরচিত্রের মাধ্যমে একটা সময়কে বুঝতে পারলেও চলচ্চিত্রের আবেদন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁদের এই ছবিতে কখনো কোন পেশাদার অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের ক্যামেরার সামনে আনা হয়নি। বরং তাঁদের ঘর বাড়ি, রাস্তাঘাট থেকে আশেপাশের বিভিন্ন ধরনের সব ছবি তোলা হয়েছে। বেবী এ্য ব্রেকফাস্ট টেবিল এ দেখা যায়, স্বয়ং অঁগুস্ত লুমিয়ের ক্যামেরার সামনে। খাবার টেবিলে তাঁর বাম পাশে বসে থাকা একজন শিশুকে চা খাওয়াচ্ছেন। শিশুর পাশে বসে আছেন মার্গারেট নামের এক মহিলা। চিত্রে তিনজনের এই অন্তরঙ্গতা দেখে অনুমান করতে ভুল হয় না যে অঁগুস্ত লুমিরেরের পরিবার। ছবিতে বোঝা যায় ঘরের বাইরে লনে বসে তারা তাদের নাস্তা খাচ্ছেন। পেছনে গাছের দুলে ওঠা পাতার স্তির থেকে ছবিটি তোলা হয়েছে।
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম কমেডি হচ্ছে ওয়াটারিং দ্য গার্ডেন ছবিটি। বাগানে মালি পাইপের মাধ্যমে ফুলের গাছে পানি দিচ্ছে। মগ্ন মালি যখন ব্যস্ত। তখনই এক দুষ্ট বালক পিছন থেকে এসে পাইপে পা দিয়ে চেপে ধরে। পানি বের না হওয়ায় মালি পাইপের নলে চোখ লাগিয়ে দেখার চেষ্টা করার সময়ই বালকটি পা টেনে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে পানির ঝাঁপটায় মালির চোখ মুখ আর কাপড় ভিজে যায়। তারপর শুরু হয় মালির ছেলেটিকে পাকড়াও করার দৃশ্য। ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর লুমিয়ের ব্রাদার্সের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে এই ছবিটি দেখানো হয় যা চলচ্চিত্রের মত নতুন একটা আবিস্কার দেখতে আসা উৎকণ্ঠিত দর্শকদের হাসির উপাদান যোগায়।
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম কমার্শিয়ালও লুমিয়েররা তৈরি করেন। কমার্শিয়ালটির নাম কার্ড গেম তবে আশ্চর্যের বিষয় বিয়ারের এই বিজ্ঞাপন চিত্রে পর্দায় দেখা যায় লুমিয়েদের বাবা আঁতোয়া লুমিয়েরের এবং শ্বশুর ভ্যানক্লোয়ারকে। উল্লেখ্য, ভ্যানক্লোয়ারের দুই কন্যাকে দুই ভাই বিয়ে করেছিলেন। তাদের সাথে আরেকজন বসে তাস খেলছিলেন তবে তাঁর কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। এই তিনজন ছাড়াও ফ্রেমে ওয়েটার থাকে যে বিয়ারের গুণগান বর্ণনা করতে দিয়ে অতি নাটকীয়ভাবে অভিনয় করেন।
লুমিয়েরদের তৈরি প্রথম মাস্টারপিস বলা যেতে পারে এ ট্রেন রিচেস দ্য স্টেশন ছবিটি। ফ্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকছে ক্যামেরা স্থির করে একই জায়গায় রাখা হয়েছে। কিন্তু ছবির কম্পজিশন ও ফ্রেমিং সত্যিই অপূর্ব। ট্রেন থামার পর যাত্রীর উঠানামা এবং ক্যামেরার সামনে দিয়ে যাত্রীদের একা অথবা দলবদ্ধভাবে হেঁটে চলা এত ছন্দময় যে দর্শকদের অভিভুত হতে হয়। সেই সাথে সাদাকালো রঙের ব্যবহার ছবিটির আবেদন অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। লুই লুমিয়ের নিজেই একজন খুব দক্ষ ফটোগ্রাফার ছিলেন। ফলে তাঁর মধ্যে ফ্রেমিং ের ধারণা খুবই সূক্ষ্ম ও যাথার্থ ছিল।
প্রথম দিককার কিছু ছবিতে ক্যামেরা স্থির থাকলেও পরের বেশ কিছু ছবিতে ক্যামেরা মুভ করেছে। এমনই একটি ছবিতে দেখা যায় ট্রামের লাইন ধরে ক্যামেরা এগিয়ে যাচ্ছে। সেই সময়কার প্যারিসের রাস্তার চিত্র ভেসে আসে পর্দায়। প্যারিসের রাস্তার ইতিহাসও খুঁজে পাওয়া যায় এ ছবিটি। মোটর গাড়ির পাশাপাশি ট্রাম এবং বিভিন্ন ধরনের ঘোড়ার গাড়ি দেখা যায় এই ছবিতে এবং সেই সাথে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারী।
লুমিয়েরদের আরেকটি বিখ্যাত ছবি বয়েজ অন দ্য স্ট্রিট। ছবিটি সেই সময়ের ফ্রান্সের আর্থ-সামাজিক চিত্র দর্শকদের কাছে তুলে ধরে। ফুটপাতের ক্ষুধার্ত বালকগুলো একটি বল নিয়ে খেলছে। তাদের মধ্যে কেউ আবার মারামারি করছে। ছবিটি দেখে মনে হয় একশ বছর আগে ফ্রান্সের অসংখ্য শিশুর অবস্থা বর্তমানে আমাদের দেশে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো শিশুদের মত ছিল।
ফ্রান্সের আভ্যন্তরীণ জীবন যাত্রা ক্যামেরায় তুলে ধরার পর লুমিয়েররা ক্যামেরা নিয়ে ফ্রান্স থেকে বের হলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। আমেরিকা এমনকি মিশরে গেলেন ছবি তুলতে। মানুষজন, প্রাণী, রাস্তাঘাট, নদী, বন, সৈনিকদের ছবি তোলার সাথে সাথে সার্কাস দলেরও ছবি তুলছেন। মিশরে গিয়ে তুললেন পিরামিড ও স্ফিংস এর ছবি। ফলে তাদের ছবিগুলো নিছক বিনোদনের মাধ্যমে হলো না, বরং হলো এক ঐতিহাসিক দলিল।
অগুস্ত লুমিয়ের এবং লুই লুমিয়ের-এর অদ্ভুত আবিস্কার যখন পৃথিবীর মানুষের বিস্ময় সৃষ্টি করেছে এবং তাদের প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক বানিয়েছে, তখন বাবা আঁতোয়া লুমিয়ের নীরবে সন্তানদের সাফল্য দেখেছেন আর মনের আনন্দে সুখ অনুভব করেছেন। তিনি খুব গর্ব অনুভব করতেন যে, তাঁর দুই সন্তান তাঁর কথা রেখে পৃথিবীর মানুষের কাছে সম্মানিত করেছেন।
তরুণ বয়সে যে আঁতোয়া লুমিয়েরের গভীর উদ্দীপনা ছিল রং তুমি নিয়ে ছবি আঁকায়, তিনি জীবনের মাঝখানে নিজেকে ছবি আঁকা থেকে গুঁটিয়ে নিয়েছিলেন মূলত আর্থিক কারণে। তবে সন্তানদের সাফল্য এবং চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর স্বপ্ন পূরণ তাকে আবার পুরদস্তুর চিত্রশিল্পী বানিয়েছিল। ১৯১১ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি প্রায় সব সময়ই ছবি আঁকায় নিমগ্ন থাকতেন।
লুমিয়েরদের প্রদর্শিত প্রথম দশটি ছবিঃ