দেশঃ জার্মানি, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য।
পরিচালকঃ মাইকেল হফম্যান।
লেখকঃ জেই পারিনির উপন্যাস অবলম্বনে মাইকেল হফম্যান।
রিলিজ ডেটঃ ২৩ ডিসেম্বর ২০০৯।
মুখ্য চরিত্রঃ ক্রিস্টোপার প্লামার, হেলেন মিরেন, কেরি কনডন।
কোন গাছের শিকড় কোন অন্ধকার হাতড়িয়ে দুর্ভেদ্য মাটি ভেদ করে অপর কোন গাছের শিকড়কে আঁকড়ে ধরে আছে কিনা তা নিয়ে মানুষের মাথাব্যাথাটা একটু কম। ব্যাথার বদলে মাথাভর্তি বুদ্ধি খেলা করে যায় সুন্দরবনের সুন্দরি গাছের ডালে মৌমাছির বাঁধা চাক দেখে। পরনে মোটা কাপড় পরে, হাত-পায়ে মোজা পরে সন্তর্পণে আগুনের ধোঁয়া দিতে হবে মৌমাছির চাকে। মধুকে বুকে আগলে প্রহরারত মৌমাছি জেই ভয়ে পালাবে এমনি লম্বা দা বের করে এক কোপে ডাল থেকে চাক আলাদা করে ঘরের ছেলে মৌমাছির দীর্ঘ পরিশ্রমের সঞ্চিত মধু পাত্রে ভরে নিয়ে ঘরে ফিরবে। তারপর প্রতি প্রত্যুষে উষ্ণ এক গ্লাস জলে দুফোঁটা মধুর সাথে কাগুজে লেবুর রস মিশিয়ে খেতে খেতে বলবে, বার বার বলি এত সঞ্চয় ভালো না তবু মৌমাছিরা সে কথা শুনল না। এখন দেখো কার চাষের ফলন কার গোলায় ওঠে। গোলায় যার ওঠে সে যেমন ভাবে এটা তার পৈতৃক সম্পত্তি, স্বাভাবিকভাবেই প্রাপ্য ঠিক তেমনিভাবে পুত্র-কন্যারা ভাবে বার্ধক্যে জ্বরাগ্রস্থ পিতা-মাতার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিও একমাত্র তাদেরই প্রাপ্য। ফলে উইল বা দলিলনামা করে সেসব হস্তান্তর করা একান্তই অতি আবশ্যক। যার নামে উইল সেই বাবা-মা যদি জীবন সংগ্রামে লড়তে লড়তে সময়াভাবে উইল লেখার সময় নাও পায় তথাপি সুসন্তানেরা শুভস্য শীঘ্রম জ্ঞানে বাবা-মাকে দিয়ে জীবদ্দশায় করণীয় কাজ করিয়ে নেয়। হোক না হাসপাতালের বিছানায় বাবার মুমূর্ষুদশা, তবু ছেলে মেয়েদের তো জানা চাই বড় ভাই পাবে আমের বাগান নাকি মেঝ ছেলে পাবে উঠান সমেত টিন ছাদের মাটির দালান। মেয়ে জামাইরা যে বঞ্চিত হয়ে না সে নিশ্চয়তাও তো পাওয়া চাই। বাচ্চা না কাঁদলে নাকি প্রাণপ্রিয় মাও দুধ খেতে দেন না বলে হিসেবী সন্তানেরা এই সময় কিছুতেই বেহিসেবী হন না। বুকে যদি দম নিতে যেয়ে বুক বন্ধ হয়ে মরার দশাও হয় তথাপি মুমূর্ষু পিতার হাতে কলম তুলে দিয়ে দলিলে সই করিয়ে নিতে সন্তানরা মুহূর্তমাত্র কার্পণ্য করে না। ঝাপসা চোখে কাগজের লেখা লাইনগুলো আর পড়া হয় না। চোখ বেয়ে গড়িয়ে ঝরে অশ্রুধারা। হায়রে আমার জীবনভর পরিশ্রমের উপার্জন। এগুলোর শুধু মূল্য আছে। আমার কোন মূল্য নেই। সন্তানরা কেউতো আমায় চাইল না। ওদের মাকেও না। শুধুমাত্র চাওয়ার মধ্যে পার্থিব উপার্জন। অর্জনের কি কোন মূল্য নেই। আমার বেঁচে ওঠাটা ওদের কাছে কিছু না। মরে যাবার আগে সহায়-সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়ে যাওয়াটাই ওদের একমাত্র চাওয়া। এই আমবাগান, টিনচালের মাটির দালান, উত্তর পাড়ের শান বাধানো পুকুর, পাট বিক্রিত লাখ টাকা, বউয়ের আমার গয়না, গোয়ালের দশটা গরু আরও কর সব এতটা বছর যক্ষের ধনের মত বুক পেতে আগলালাম। এতসব কিছুর কিছুই আজ থেকে আর আমার না। ওদের মারও না। পিতৃস্নেহ-মাতৃস্নেহ কিছুই কিছু না। সহায় সম্পত্তিই সব। দলিল নামায় সাক্ষর দিতে চাই কিংবা না চাই সেসব কিছুই কিছু না। তবে এই মায়ার সংসারে আর কোন বাঁচি। সম্পদ পেলেই যদি ওরা সব পায় তবে আর আমার কোন বাঁধ সাধা। বাবার, হাতে তো আর শক্তি নেই। লিখতে পারার ক্ষমতাও নেই। তেমরাই হাতের মধ্যে কলম রেখে একটু শক্ত করে চেপে ধরো। লিখতে পারি না তো, তোমরাই লিখিয়ে নাও যেমনভাবে পারো তেমনভাবে। এত পরে কেন বুঝলাম জীবনভর ভস্মে ঢাললাম ঘি। দলিলনামায় স্বাক্ষর হয়ে গেল। বাবারা, সম্পত্তি আমায় ছেড়ে চলে গেল, আমার করা দলিলনামায় আমারই করা স্বাক্ষরের জরে। কিন্তু তোমারতো আমার উপার্জন না, অর্জন। আমার, তোমার মায়ের। এই অবেলায় তোমরা আমাদের ফেলে যেও না। সম্পদের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। এই যে আমরা আমাদের সারাটা জীবনের সমস্ত উপার্জন যে তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম তথাপি আমরা সুখী, আমাদের হৃদয়ে তৃপ্তি। কারণ তোমরা আমাদের সন্তান। আমরা তোমাদের মা-বাবা। এই যে স্নেহের বন্ধন সেই বন্ধনের মাঝে দাড়িয়ে আজ পর্যন্ত কোন দলিলনামা তৈরি হয়নি যেখানে সি করলে আমরা তোমাদের থেকে আলাদা হতে পারি। পার্থিব সম্পদের ক্ষয় আছে, কিন্তু অর্জিত পুণ্যের কোন ক্ষয় নেই। দলিলের স্বাক্ষর ছাড়াই আমরা তোমাদের বাবা-মা, আর টা থাকবো আজীবন।
জীবনের টানাপোড়নের মাঝে বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনের প্রবাদপুরুষ রুশ সাহিত্যিক লিও তলস্তয়কেও জীবনের শেষ বেলায় এরকমই একটি দলিলনামায় স্বাক্ষর করতে হয়েছিলো। দলিলে স্বাক্ষর করার কারণে লিও তলস্তয়ের উপর বয়ে যাওয়া ঝড় বাতাসের দোদুল্যমান অবস্থার আলোকে চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট স্টেশন স্ত্রীবন্ধন হতে স্বামীর মুক্তি পাওয়াটা কত কঠিন তার আলোকে দ্য লাস্ট স্টেশন। একজন লেখক-কবি-সাহিত্যিকের কাছে বাস্তব পৃথিবী অপেক্ষা মনোজগৎ কত মূল্যবান রাত রাত আলোকে দ্য লাস্ট স্টেশন। ৮২ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকা “ওয়ার অ্যান্ড পীস” কিংবা “আনা কিরেনিনা” খ্যাত ঔপন্যাসিক লিও তলস্তয়ের জীবনের শেষ বছরের প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট স্টেশন। ২০০৯ সালে লিও তলস্তয় চরিত্রে অভিনেতা ক্রিস্টোফার প্লামার এবং লিও তলস্তয় পত্নী সোফিয়া তলস্তয় চরিত্রে অভিনেতা হেলেন মিরেন অভিনীত চরিত্র দু’টি অস্কার পুরুস্কারের জন্যে মনোনীত হওয়া চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট স্টেশন। ঔপন্যাসিক জেই পারিনি রচিত জীবনী আশ্রায়ী উপন্যাস দ্য লাস্ট স্টেশনের আলোকে পরিচালক মাইকেল হফম্যান পরিচালিত চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট স্টেশন। যুদ্ধমগ্ন ধারিত্রীতে শান্তির বারতা ছড়িয়ে দেওয়া, জীবদ্দশায় সমগ্র ইউরোপের আত্নার কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা লিও তলস্তয়ের শেষ দিন-রাত্রিগুলোর মরমীয় মর্মগাথা চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট স্টেশন।