ফালগুনী রায়
পুরো ৩৬ বছরও বাঁচেন নি ফালগুনী। জন্ম ৭ই জুন ১৯৪৫-এ আর মৃত্যু ৩১শে মে ১৯৮১।
বেঁচে থাকতে ফালগুনীর একটি মাত্র কবিতার বই বেরিয়েছিল, ১৯৭৩ সালে, “নষ্ট আত্মার টেলিভিশন”। হাংরি বুলেটিন, উন্মার্গ, জেব্রা, ক্ষুধার্ত খবর, ফুঃ, আর্তনাদ, প্রতিদ্বন্দ্বী, আবহ, গল্পকবিতা, কৃত্তিবাস, হাওয়া ৪৯, গোলকধাঁধা… এইসব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তাঁর লেখা। প্রায় সন্ত্রাসবাদীর তৎপরতায় ফালগুনী বরাবর বেপরোয়া আক্রমণ করে গ্যাছেন তথাকথিত ‘সাহিত্য’ ও ‘সাহিত্যিকতা’-কে। বিস্ফোরক ফালগুনী সবকিছু তছনছ করে দিতে চেয়েছেন… নিজের জীবনকেও। “জরায়ু”, “মানুষ-মানুষী”, “অন্তিম জরায়ু” – তিনটি চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। লিখেছিলেন “কালো খ্রিস্ট” নামের নাটক আর “কাঠের ফুল” ও “অহং” – এই দুটি গদ্য। আসুন, ফালগুনী রায়ের কিছু কবিতা পড়া যাক এবার…
ব্যক্তিগত নিয়ন
আমি পুরোপুরি প্রতিভাহীন তাই নাকে জিভ ঠেকিয়ে
প্রমাণ করি প্রতিভা
কখনও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির সাম্নে দিয়ে হাঁটতে
হাঁটতে ভাবি – একদিন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে-রাস্তা দিয়ে হেঁটেছিলেন
সে-রাস্তায় আমি, অপদার্থ, ফালগুনী রায় হেঁটে যাচ্ছি, কখনও ট্রামের
সেকেন্ড ক্লাসে উঠে ভাবি – এই ট্রামটাই কি জীবনানন্দের
শরীর থেঁতলে দিয়েছিল
এইভাবেই আমি চলেছি – চলেছে পৃথিবী সূর্য নক্ষত্র আমার
আমার ভ্রূণমুহূর্তে আরেক মৃত্যু নেমে এসেছিল সৌরসংসারে
আমার এক বন্ধু বারে বসে দূর-দেশের দামি মদ খায় প্রায়ই –
সে খুব রেগেমেগে শালা তাড়িখোর গাঁজাখোর বলেছিল
একদিন আমায়
একলব্যর বুড়ো আঙুল কেড়ে নেবার জন্যে
আমি দ্রোণাচার্যকে হত্যাকারী মনে করি –
ব্যক্তিগত বিছানা
১.
শুধুই রাধিকা নয় – গণিকাও ঋতুমতী হয়
তিন সন্তানের পিতা – পরিবার পরিকল্পনার আদর্শ পুরুষ
কৈশোরে করে থাকে আত্মমৈথুন – করে না কি
২.
আমি রবীন্দ্রনাথ হতে চাই না – হতে চাই না রঘু ডাকাত
আমি ফালগুনী রায় হতে চাই – শুধুই ফালগুনী রায়
৩.
আমি যে-রাস্তায় থাকি তার এক প্রান্তে প্রসূতিসদন অন্য প্রান্তে শ্মশানঘাট
বিশ্বাস না-হয় দেখে যেতে পারেন – বাসরুট ৪, ৩২, ৩৪, ৪৩
৪.
ম্যাগাজিন শব্দটি আমি লক্ষ করেছি রাইফেল ও কবিতার সঙ্গে যুক্ত
০৯৮৭৬৫৪৩২১
কীরকম বিচ্ছিরি দ্যাখো পেচ্ছাপের কথা
প্রেমের সময়
চুমুর শব্দে
আ হাহা যুবকদের পাজামায় তাঁবু
হযবরল লাল নিশান দুলে-দুলে
গণমত নিয়ে চলে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে
‘পাইখানা’ উচ্চারণে যুবতীদের
লাল লিপস্টিক-ঠোঁট
অলিম্পিয়ায় পাঁড় মাতাল একজন এলিট
খিস্তি করল আমায় – ‘শালা তাড়িখোর’
যখন গাববুর আড্ডা থেকে
বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটছিলুম
ঈশ্বরকে হাতের কাছে পেলে তার জ্যান্ত লাশ
মাটিতে পুঁতে শয়তানকে দিয়ে খাওয়াতুম
মদ মেয়ে কবিতার ভেতর কে বেশি রমরমে
বুঝতে পারছি না এখন – আমার কলম ‘দাদ’ লিখতে
গিয়ে ‘হে নারী হে রূপসী’ লিখছে – ‘হে নারী হে প্রিয়া’
লিখতে গিয়ে ‘দাদ চুল্কুনি’র কথা লিখে ফেলছে।
অনাবশ্যক কবিতা
পৃথিবীর প্রাচীন পিঠের ওপর আমি এক নবাগত আগন্তুক
এখন কবির হাতের শিরা কেটে যখন রক্ত নিচ্ছেন চিকিৎসক
তখন আমার মনে পড়ছে আমি নিজের রক্ত বেচে মদ
গিলে লিখতে চেয়েছিলুম কবিতা
আমি কি উচ্ছন্নে গেছি? – এখনো অনেক রহস্য রয়েছে প্রচ্ছন্ন
এখনো আমি মরতে ভয় পাই, অর্থাৎ বাঁচতে ভালোবাসি
তাই মেঘলা আকাশের তলায় এক হাতে রেড বুক অন্য হাতে
জীবনানন্দের কবিতা
নিয়ে আমি হেঁটে যাই – মেঘের ছায়ায় যারা রোদ-চশমা পরে
তাদের আমি অপছন্দ করি – যারা সংসারে দাগা খেয়ে ঈশ্বরের
কথা ভাবে
তাদের আমি অপছন্দ করি – যারা দেববিগ্রহে লাথি মেরে প্রশ্ন করে
what is what তাদের আমি ভালোবাসি খুব – আমি উৎসাহের সঙ্গে
মার্কস লেনিন সার্ত্র জয়েস কাফকা নিয়ে কফিহাউসে ধ্বংস করলুম চার্মিনার
তারপর একা মানুষের ভিড়ের ভেতর হেঁটে গেলুম নির্জন, আসলে
আমি আর গ্রন্থের কাছে কিছু পাচ্ছি না – প্রেমিকার কাছে কিছু পাব
বলে তার কাছে ছুটে গিয়ে দেখি – সে শুয়ে আছে আমার
অফিসার দাদার সঙ্গে
আমি বেকার বেশ্যাদের কাছে বলে এলুম ভালোবাসা – আমার
অফিসার দাদা
বোনাসের টাকায় আমার প্রেমিকাকে শাড়ি কিনে দিয়ে তার লাভার
হয়ে গ্যালো
অই টাকায় আমার একমাসের খাবার খরচ হয়ে যেত অর্থাৎ আমার
ভাবী স্ত্রীর
শরীর ঢাকার দাম আমার খোরাকি খরচের সমান ভাবা যায়
আমাদের বেঁচে থাকা
তবু আমি ভালোবাসি উলঙ্গ শিশুটির হাসি, পুরানো পৃথিবী নতুন
হয়ে ওঠে আমার ক্ষুধার্ত চোখের সামনে সুন্দরী রমণীর হাড়ের কাঠামো
সময়ের ভেতর দিয়ে চিতার দিকে চলে যায় – আমি দর্শনের একটা মোটা বই
বিক্রি করে কিনি রুটি ও মদ শুধু বেঁচে থাকার জন্যে এমনকী কখনো
লিখে ফেলি, বিশ্বাস করুন লিখে ফেলি অনাবশ্যক কবিতা।
আমার রাইফেল আমার বাইবেল
আমার রাইফেল আমার বাইবেল এই নামের দুটো কবিতা পকেটে
নিয়ে আমি গল্পকবিতার পথে হাঁটি – এই পথে একজন অগ্নিযুগের
বিপ্লবীর নামে রাস্তা ও বাজার এবং একজন সত্তর দশকের শহিদের
নামে রয়েছে একটি শহিদবেদি রয়েছে কলেজ স্কোয়ারের জলে পুরনো
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গ্রন্থাগারের ছায়া রয়েছে কিছু দূরে মেডিকেল
কলেজের মর্গ আর তার উল্টোদিকে দেবালয় ও গ্রন্থালয়ের মধ্যবর্তী
পথ চলে গ্যাছে স্ট্রেট গণিকালয়ের দিকে এই পথ দিয়ে আমি হাঁটি
গল্পকবিতার দিকে – বুকপকেটে কাগজি নোটের বদলে দুটো
কবিতা – বুকপকেটের তলায় গেঞ্জি গেঞ্জির তলায় চামড়া চামড়ার
তলায় হৃদয় হৃদয়ের হাড় ভাববাচ্যে কাটা গ্যাছে আমার তবু আমি
হাড়কাটায় যাইনি এখনো কয়েকটা লেখা নিয়ে গল্পকবিতার দিকে
হেঁটে গেছি – পাঠের ক্ষুধা নিয়ে ছুটে গেছি গ্রন্থের কাছে প্রেম ও
পুরুষাঙ্গর ক্ষুধা নিয়ে ছুটে গেছি প্রেমিকার কাছে কিন্তু গ্রন্থ ফিরিয়ে
দ্যায়নি আমাকে – মানবী দিয়েছে – তারপর থেকে আমি লাল-নীল
মাছের অ্যাকোরিয়ামের পাশে বসে মাছভাজা খেয়েছি বেশ্যার উঁচু
বুকে যৌন আকর্ষণের বদলে আমি লক্ষ করেছি মাংসর ঢিবি – আমার
প্রাক্তন প্রেমিকার বর্তমান স্বামীর দাঁতের উজ্জ্বলতায় আমি টুথপেস্টের
বিজ্ঞাপন দেখেছিলুম – হাসি দেখিনি
রামকৃষ্ণ শ্মশানে জ্বলন্ত শবদেহের ঝলসানো মাংস মহাপ্রসাদ মনে করে
খেয়ে ফ্যালে নিমাই সাধু এবং এমনকী সে খিদে পেলে গঙ্গামাটি বা
স্রেফ নিজের পাইখানা খেয়ে ফেলে ও গাঁজা খায় এবং হরিনাম করে
– নিমাইসাধুকে অনেকেই মুক্তপুরুষ ভাবে আমিও মুক্তি চাই কিন্তু সে
মুক্তি মানে পোড়া মড়ার ঝলসানো মাংস ছিঁড়ে খাওয়া কিম্বা মাটি বা
নিজের গু খাওয়া নয় – চে গ্যেভারাও মুক্তি চেয়েছেন এবং পরাধীন
ভারতের কবি লিখেছিলেন যেথায় মাটি ভেঙে করছে চাষা চাষ কাটছে
পথ খাটছে বারোমাস সেখানেই দেবতা আছেন দেবতা নাই ঘরে- এই
ধরনের মুক্তিপ্রসঙ্গ লেখা হয়েছিল স্বাধীনতার আগে – আমি আজ
স্বাধীন ভারতের কবি দরিদ্রতার হাতে বন্দী অগণন শিশুর নির্ভেজাল
হাসি দেখে তাদের মুক্তির পথের কথা ভাবি – পেটোর বদলে দুটো
কবিতা পকেটে নিয়ে গল্পকবিতার দিকে হাঁটি এই পথে একজন
অগ্নিযুগের বিপ্লবীর নামে রাস্তা ও বাজার আছে, আছে সত্তর দশকের
একজন শহিদের জন্যে একটি শহিদবেদি এই পথে