১০ এপ্রিল, ২০১৯ রাত তখন আনুমানিক সাড়ে ১০টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন অ্যান্ড পাস্টিক সার্জারি ইউনিটে শোনশান নিরবতা। যারা রাতে ডিউটি করছেন শুধু দু-একজন মাঝে মাঝে ঘুরাফেরা করছে। এর কিছুক্ষণ আগে বাবা এসেছিল, আমার পাশে কিছুক্ষণ বসে ছিল। আমার অনেক কথা জমা ছিল বাবাকে বলবো বলে, কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয়নি। শুধু বাবার কাছে পানি খেতে চেয়েছিলাম, হাসপাতালের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাও জুটেনি।
আসলে আমার ভাগ্যটাই মনে হয় আমার বিপরীতে চলে। না হলে সেদিন অধ্যক্ষ সার আমার প্রতি লোলুপ দৃষ্টি এবং আমার গায়ে হাত দেওয়ার প্রতিবাদ করায় সবার বিরাগভাজন হয়েছি। যার জন্য আমি কয়েকবার আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলাম। তখন হয় আত্মহত্যা করলে হয়তো বেচেঁ যেতাম। গত দুই সপ্তাহ যাবত যে কষ্ট এবং মানুষের ভয়্ংকর আচরণ তা হয়তো দেখা হতো না। কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ সে পাপ অর্জন থেকে অন্তত রক্ষা পেয়েছি।
যে সহপাঠীকে মারধরের খবর শোনে আমি মাদ্রাসার ছাদে গিয়েছিলাম, সেখানে আমারই কাছের মানুষের আগুনে পুড়তে হলো।
শুধু ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা একা নন। হঠাৎ করে কেবল আমাকেই তিনি হেনস্তা করেননি। বছরের পর বছর তিনি যৌন নিপীড়ন করে আসছেন। তাঁর মতো আরও অনেকেই ভদ্রবেশে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুখোশ পরা এসব লোককে ভণ্ডামি করতে দেওয়াই এখন রীতি। আমি সেই রীতির বাইরে গিয়েছিলাম। আওয়াজ তুলেছিলাম। কিন্তু কেউ আমার পাশে দাঁড়ায়নি। না প্রশাসন, না পুলিশ, না বন্ধু, না প্রতিবেশী। আগুন দেওয়ার ভয়ংকর ওই সময়েও ছাত্রীদের কেউ তাঁর হাত, কেউ পা ধরে এবং গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর তো সবটাই যন্ত্রণার।
একি!! আমার জ্বালা-পোড়া শরীরের যন্ত্রণা কমে অন্য এক অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব করছি। আমার দেহ ধীরে ধীরে নিথর হয়ে আসছে। চোখগুলো বন্ধ হয়ে আসছে। বাবা মনে হচ্ছে বারবার বলছে, মা চোখ বন্ধ করিস না। তুই না থাকলে তোর রেখে যাওয়া কাজগুলো করবে কে!! তোর যে অনেক কাজ বাকী আছে। তুই এভাবে আমাদের ছেড়ে যাস নে মা।
এখন আমাকে কেউ আর কটুক্তি করতে পারবে না। হয়তো কখনো আবার নতুন কোনো নুসরাত তৈরি হবে। শুনেছি আমার নাকি আবার ময়নাতদন্ত হবে!! তাতে কি লাভ হবে!! এ পোড়া শরীরে কারো হাতের স্পর্শই তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
শুধু পাওয়া যাবে, নুসরাতের বয়স ১৮ বছর। মাথার চুল কালো ও পোড়া, লম্বা অনুমান ১৮ ইঞ্চি। কপাল স্বাভাবিক। উভয় চোখ ও মুখ বন্ধ, নাক দিয়ে সাদা ময়লা বেরিয়ে এসেছে। মুখমণ্ডল গোলাকার, উভয় কান, থুতনি, গলা, ঘাড়সহ পোড়া ও ঝলসানো। উভয় হাতের আঙুল পর্যন্ত রাউন্ড গজ-ব্যান্ডেজ, যাতে পোড়া ঝলসানো। গলার নিচ থেকে বুক-পেট-পিঠ-যৌনাঙ্গ-মলদ্বারসহ উভয় পায়ের পাতা পর্যন্ত রাউন্ড গজ-ব্যান্ডেজ, যাতে পোড়া ঝলসানো। গায়ের রঙ ফর্সা, লম্বা অনুমান ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। পরনে রাউন্ড গজ ছাড়া কিছু নেই, সরকারি চাদর দিয়ে ঢাকা।
তবুও শুনেছি কাল সকালে আমার ময়নাতদন্ত হবে। বাবা তুমি এর মধ্যে কোথাও যাবেনা। আমার বড্ড ভয় হয়। এতো পাহাড়ার মধ্যেও কাউকে আপনা মনে হয়না। তা না হলে, আমার মাদ্রাসায় এতো মানুষ-পাহাড়া থাকা স্বত্বেও আমাকে পুড়তে হলো। চারদিকে কতইনা নিস্তব্দ নিরবতা। আশেপাশে সারি সারি লাশ পরে আছে। পাশ থেকে কারো মৃত্যু যন্ত্রণার কাতরানো শোনা যাচ্ছে। কেউ আবার আমার সাথে যুক্ত হচ্ছে। কেউ আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে।
যথাসময়ে আমাকে ময়নাতদন্তের জন্য নেওয়া হলো। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে নতুন কিছু বেরিয়ে আসলো না। শুনেছি খুব তাড়াতাড়িই আমাকে আমার নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। আমার জন্য শতশত স্বজন অপেক্ষায় আছে।
আমাকে একটি হিমশীতল গাড়িতে উঠানো হলো, সামনেই আমার বাবা বসে আছে। আমি একা এই হিমশীতল গাড়িতে শুয়ে আছি। গাড়ি চলা শুরু করেছে। শহুরে ব্যস্ততা। কতশত ছুটাছুটি-কোলাহল। এভাবেই শহর থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে ফেনীর সোনাগাজীর দিকে ছুটছে গাড়ি। সবকিছুই পেছনে ফেলে ছুটে চলেছি।
কিন্তু যতই সোনাগাজীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে গাড়ি। ততই আমার বুকে অজানা ভয় কাজ করছে। যাকে মাদ্রাসায় সবাই ‘হুজুর’ ডাকত। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তাঁর। কেউ খোঁজ রাখে না শিক্ষকের নৈতিকতাই টলমলে। সব জেনেও, সব বুঝেও চোখ–কান বুজে চলে সবাই। শিক্ষার্থীরা সিরাজ উদ দৌলার অধীন। মাদ্রাসায় তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। তাই সুযোগ পেলেই ছাত্রীদের ওপর যৌন নিপীড়ন চলে।
ধীরে ধীরে লাশবাহী গাড়ি সোনাগাজীর দিকে যাচ্ছে, আমারই মাদ্রাসার পাশ দিয়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই চিত্র যখন কিছু মুখোশধারী মানুষগুলো আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কি বিভৎস যন্ত্রণায় কাতরাতে হয়েছে আমাকে। এভাবে আমাকে পুড়িয়ে মারতে একটুও বুক কাপলো না তোদের!!
আমাদের বাড়িতে কত স্বজন আমার অপেক্ষায় বসে আছে। শুধু নেই আমি। কই আমিতো আছি। লাশ হয়ে আসছি। বাড়ি থেকে বিদায় নিতে হবে এখন। মায়ের ভগ্ন হ্রদয় ও ছোট ভাই রায়হানের মলিন চেহারাটা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে।
ছাবের সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আমার জানাজায় হাজার মানুষের ঢল নেমেছে। আহা, তারা যদি জীবদ্দশায় আমার পাশে দাঁড়াতো! তাহলে হয়তো এভাবে লাশ হয়ে সবার সামনে আমাকে আসতে হতো না।
আমি এক সময় মনে মনে শপথ নিয়েছিলাম। অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করবো। ঝাঁপিয়ে পড়বো। প্রতিকার হয় কি না, পরে দেখা যাবে। পবিত্র কোরআন বা হাদিসও তো তাঁকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। সৎ পথে চলতে বলেছে।
ফেনীর সোনাগাজী স্কুল মাঠে জানাজায় অংশ নেয় হাজারো মানুষ। আমার বাবা আমাকে যেভাবে ছোটবেলায় কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। তেমনি করে বাবা আমাকে তার কাধে করে জানাজা দিতে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাবাকে অনেক ক্লান্ত এবং কুজো দেখাচ্ছে। এসময় হয়তো বাবার কাধে সন্তানের লাশের ওজনের চেয়ে ভারী আর কিছু পৃথিবীতে নেই। জানাজা শেষে করবস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আমি সেখানে চিরতরে ঘুমিয়ে যাবো। আপনারাও যার যার মতো ঘুমিয়ে থাকবেন না। আমার স্বপ্নগুলোকে মেরে ফেলবেন না। এমন সিরাজ উদ দৌলা সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে। সুযোগ পেলেই তারা তাদের রূপ ধারন করে স্বগর্বে বেড়িয়ে আসে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন/ ১৬ এপ্রিল, ২০১৯। রাত ১২টা ৪৫ মিনিট/টোকিও
সংবাদকর্মী
Email: mamunjp007@gmail.com