Site icon দ্বিপ্রহর ডট কম

বসন্তের গান- আশির আহমেদ

বসন্তের গান

শীত যাক বা না যাক এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে জাপানের বসন্ত শুরু। বসন্ত মানে সাকুরা। বসন্ত মানে নুতন শিক্ষা বছর। বসন্ত মানে বড় হয়ে উঠা (শিশুরা মনে করে তাদের বয়স এক বছর বেড়েছে)। বসন্ত মানে ঠোঁট-কাঁপানো শীতকাল পেরিয়ে ঠোঁট-হাসানো নুতন ঋতু।

বসন্ত সবার জন্যই সুখবার্তা নিয়ে আসে না। আজ তেমন একজনের গল্প বলবো। গল্প নয়, আত্ম ছ্যাকা খাওয়া জাপানি এক বিনয়ী প্রেমিকের কথা। একটা জাপানি গানের কথা।
বসন্ত এলেই তার প্রেমিকা কলেজ পাস করে অন্য শহরে চলে যাবে। বসন্তটা চলে আসুক সেটা সে চাচ্ছে না।

সময়টা সত্তরের গোড়ার দিকের। শীত গেল। বসন্ত এল। মেয়েটির শহর ছেড়ে যাবার পালা। ছেলেটি এসেছে তাকে বিদায় দিতে। টোকিও র কোন এক ট্রেন স্টেশনে। দুজনেই ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকানোর উদ্দেশ্য ভিন্ন।

মেয়েটি চাচ্ছে সময়টা আসছে না কেনো।
ছেলেটি চাচ্ছে সময়টা থামছে না কেনো।

এনালগ আমলের ঘড়ি। সেকেন্ডের কাটা ঠক ঠক করছে। তার চেয়ে দেড়গুন স্পীডে ধক ধক করছে তার হৃদয়। মেয়েটির কাছে ছেলেটি তার অন্য দশজনের মত একজন বন্ধু মাত্র। কিন্তু ছেলেটির অন্তরে অন্য কিছু লেখা। বন্ধু থেকে এই ছেলে যে প্রেমিক ক্যাটাগরিতে নিজেকে আপগ্রেড করেছে তা মেয়েটি জানেনা। জানলে ও না জানার ভান করে আছে। মেয়েটির মনে হয়তো অন্য কেউ আছে। মেয়েটির অনুভুতির কথা গানে বলা নেই।

গানটির টাইটেল হলো “নাগোরি য়ুকি” – বাংলা করলে হবে আকালের তুষার। বসন্তের শুরুতে টোকিওতে তুষার পড়ার কথা না। আজ তুষার পড়ছে। তুষার পড়ার আগাম বার্তা ছেলেটি জানতো। বসন্ত আসবে মেয়ে টা চলে যাবে এই আগাম বার্তা ও তার জানা ছিল। তুষার পড়া যতই মধুর হোক না কেন, বসন্তের শুরুতে কেউ তুষার চায় না। মেয়েটা তার জীবন থেকে চলে যাবে এটা ও সে মেনে নিতে পারছেনা। বিস্বাদঘন এক মুহুর্ত।

মেয়েটি বরং উপভোগ করছে। বিড়বিড় করে বলেই বসলো টোকিওতে এটাই তো “শেষ” তুষার দেখা। “শেষ” শব্দ টা ছেলেটির হৃদয়ে অন্যভাবে বিঁধলো। সে না শুনার ভান করলো। ট্রেন আসবে আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই। ছেলেটা ধক ধক হৃদয়ে ঘড়ির টিক টিক শব্দ শুনছে। ট্রেনটা আসলেইতো সব শেষ। মেয়েটা তাকে “বিদায়” বলবে, এই ফরমাল ভদ্র শব্দটি সে শুনতে চাচ্ছে না। এই আনুষ্ঠানিকতা সে মেনে নিতে পারবে না।

সময়মতো ট্রেন এলো। মেয়েটি স্বাভাবিক ভাবেই দৌড়ে ট্রেনে উঠলো।

মেয়েটি কাচের জানালায় মুখ লাগিয়ে কি যেন বলতে চাচ্ছে।
ছেলেটি ভয়ে মেয়েটির দিকে তাকাতে চাচ্ছে না।

যদি মেয়েটি “সায়োনারা(বিদায়)” বলে ফেলে এই ভয়ে সে নীচের দিকে তাকিয়ে রইলো। বিদায় শব্দটি শুনতে চাচ্ছে না। ট্রেন নির্দিস্ট সময়ে নিজ গতিতে চলে গেল।

ছেলেটি সদ্য উত্তপ্ত হওয়া রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে আছে। ধবধবে সুন্দর তুষার কণা ছন্দের মত পড়ছে আর পড়া মাত্রই লৌহ কঠিন রেললাইনে নিমেষেই মিশে যাচ্ছে। তুষার কে জমতে দিচ্ছেনা।
মেয়েটিও তার লৌহ কঠিন হৃদয়ে ছেলেটির কোন নিবেদনই জমতে দেয়নি।

মেয়েটিকে প্রশংসা করার মাধ্যমে সে তার আক্ষেপের কথাটি জানিয়েছে বার বার –

ইমা হারু গা কিতে কিমি ওয়া কিরেই নি নাত্তা। কিওনেন য়রি জুত্ত কিরেই নি নাত্তা।
বসন্ত এল তুমি সুন্দর হয়ে উঠলে। গতবছর থেকেও আরো সুন্দরী । বসন্ত এল তুমি সুন্দর হয়ে উঠলে।

ছেলেটার সমস্ত নালিশ এই বসন্ত কে নিয়ে।
এই বসন্তই মেয়েটাকে সুন্দর করে তুললো। এই বসন্তেই মেয়েটা তার জীবন থেকে নাই হয়ে গেল।

Exit mobile version