বাংলাদেশে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি’র কর্মকর্তারা বলেছেন, উচ্চ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা এবং বিসিএস ও ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার নিয়োগসহ পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস এবং জালিয়াতির সাথে জড়িত চক্রকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সিআইডি’র কর্মকর্তারা বলেছেন, অভিযুক্তরা ছাপাখানা এবং কোচিং সেন্টার থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় একটা চক্র হিসেবে কাজ করে আসছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির একটি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগ নিয়ে সিআইডি পুলিশ তদন্ত শুরু করেছিল দেড় বছর আগে।
এখন তদন্ত শেষ করে চার্জশিট বা অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। ঈদের পর আদালতে এই অভিযোগপত্র পেশ করা হবে বলে সিআইডি’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস হয়?
সিআইডি’র এই তদন্ত দলের প্রধান এবং বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেছেন, ছাপাখানা থেকে প্রশ্ন ফাঁস করে তা চড়া দামে বিক্রি করা পর্যন্ত একটি চক্র কাজ করে।
আরেকটি চক্র প্রশ্ন পাওয়ার পর সেগুলোর সমাধান করে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে তা সরবরাহ করে। এই দু’টি চক্রকেই তারা চিহ্নিত করতে পেরেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
মি. ইসলাম বলেছেন “ছাপাখানা থেকে এবং পরে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস করার সঙ্গে এই দু’টি চক্রেরই যারা জড়িত ছিল, তাদের মোটামুটি সকলকে চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করেছি। এখন ১২৫জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছি। আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছি। তাদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ পেলে আমরা সম্পূরক চার্জশিট দেবো।”
গত কয়েক বছরে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরির বিসিএস থেকে শুরু করে ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষা এবং একের পর এক বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল।
যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির একটি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছিল সিআইডি পুলিশ।
কিন্তু সিআইডি দাবি করেছে, তাদের তদন্তে চিহ্নিতরা সব ধরণের প্রশ্ন ফাঁস বা জালিয়াতির সাথে জড়িত ছিল।
সিআইডি’র কর্মকর্তা মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেছেন, চিহ্নিতদের যাদের গ্রেফতার করা গেছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং তদন্তে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে চক্রগুলোর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
“এরা যত পরীক্ষা হতো, সব পরীক্ষারই প্রশ্ন ফাঁস করেছে। তারা স্বীকারও করেছে যে তারা বিভিন্ন ধরণের ব্যাংক এবং সরকারি অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানের সব নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছে। এই চক্র বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস করার কথা স্বীকার করেছে।”
যারা অভিযুক্ত হয়েছে তারা কারা
সিআইডি’র অভিযোগপত্রে যে ১২৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের ৪৭জন এখন গ্রেফতার রয়েছে।
তবে সিআইডি পুলিশ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে যে, অভিযুক্তদের বেশিরভাগই অর্থাৎ ৮৭ জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক জিনাত হুদা ওয়াহিদ বিষয়টাকে বিব্রতকর বলে মনে করেন।
তিনি বলছিলেন “এটি আমাদের জন্য বিব্রতকর। এবং যে বিশাল-সংখ্যক আমাদের শিক্ষার্থী, তাদের জন্যও এটা বিব্রতকর। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে যে ক’জন শিক্ষার্থীর কথা এসেছে, সেই সংখ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় নগণ্য। কিন্তু তারাও কেন এবং কীভাবে এমন চক্রের সাথে জড়িত হলো, এমন অনেক প্রশ্ন আসে।।”
প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে কয়েকবছর ধরে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাগুলোর সময় সামাজিক মাধ্যমের ওপর নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ রাখতেও দেখা গেছে।
সিআইডি বলেছে, তাদের তদন্তে ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করা হলেও কোচিং সেন্টার এবং ছাপাখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযুক্তরা চক্র হিসেবে কাজ করেছে।
তবে কোচিং সেন্টারের মালিকদের সংগঠনের নেতা তাসলিমা গিয়াস বলেছেন, সব সময় কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ আনা হয় বলে তারা মনে করেন।
“দেশে দুই তিন লাখ কোচিং সেন্টার আছে। এত কোচিং সেন্টারের মধ্যে কোন পরিচিত কোচিং সেন্টার এসব জড়িত থাকতে পারে না। আমরা যারা কোচিং সেন্টারের ব্যবসা করে থাকি, তারা প্রশ্ন ফাঁসের সাথে কোনভাবে সম্পৃক্ত হতে পারি না। কারণ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির প্রশ্ন থাকে।”
“দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর কথা এসেছে, তারা যদি কোন কোচিং সেন্টারে পড়ায় এবং তারা বাইরে গিয়ে কিছু করলে, সেজন্য কোচিং সেন্টার দায়ী হয় বলে আমার মনে হয় না।”
সিআইডি’র অভিযোগ পত্রের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৬৩ ধারায় এবং পাবলিক পরীক্ষা আইনে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
সিআইডি পুলিশ জানিয়েছে, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে যে ৪৭ জন গ্রেফতার রয়েছে, তাদের গ্রেফতারের সময় ৪০ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল।
এই অর্থের উৎস জানার জন্য মানিলন্ডারিং আইনে মামলাতেও তদন্ত চলছে।