প্রবীর বিকাশ সরকার: অনেক আগের কথা। ২০০২-৩ সালের কথা হবে যতখানি মনে হয়। জাপানে ছিল তখন বিপুল কৃষ্ণ দাস। খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল তার সঙ্গে। ‘আড্ডা টোকিও’ সংগঠনটি একসঙ্গে গঠন করেছিলাম। কবি ও সংস্কৃতিকর্মী মোতালেব শাহ আইউব যার পরিচালক।
সেইসময় সে প্রায়শ একজন মানুষের কথা খুব বলত আমাকে। দু-একটি বইও দিয়েছিল। তার মধ্যে ভাঙ্গামঠ আর কল্পনা চাকমা, পড়েছিলাম। দুটোই খুব সাহসী লেখা, চমকে উঠেছিলাম! খোঁজ নিয়ে জানলাম তিনি আরও অনেক বিখ্যাত গ্রন্থের লেখক। কিন্তু পরিচয় ছিল না।
পরিচয় হয়েছিল বিপুলের বাসায় বারাসাতে ২০০৭ সালে। তখন কলকাতা বইমেলা চলছিল। তিনি তখন দিল্লির বাসিন্দা। রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। কট্টর আওয়ামী লীগপন্থী। ‘ভাঙ্গমঠ’ গ্রন্থকে কেন্দ্র বিএনপি সরকারের রোষানলে পড়ে দেশছাড়া হয়ে থাকতে হয়েছিল দীর্ঘবছর ভারতে। সেসব গভীর দুঃখজনক ইতিহাস।
কলকাতা বইমেলায় তার বই প্রকাশিত হয়েছিল সেই উপলক্ষে আগমন। আমারও একটি বই প্রবন্ধ সংকলন ‘জানা অজানা জাপান’ প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু যে প্রকাশনাকে দিয়েছিলাম যথার্থভাবে কাজটি করতে পারেনি। আমি ক্ষোভের সঙ্গে বইটি তুলে ফেলি। কিন্তু বইটির বিষয়বস্তু ব্যতিক্রম সব ইতিহাস। যা ভারতীয় এবং বৃহত্তর বাঙালির জানা নেই বললেই চলে।
সালাম ভাই বললেন, খুব মূল্যবান প্রবন্ধগুলো। এর আগে আপনার একটি প্রবন্ধ ‘জাপান-বাংলার শতবর্ষ পূর্তি’ এরকম কিছু আমি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদকের টেবিলে পড়ে থাকতে দেখে সেটা নিয়ে দৈনিক যুগান্তরে দিয়েছিলাম। ছাপা হয়েছিল? আপনি কপি পেয়েছিলেন কি?
আমি বললাম, পেয়েছি। ঢাকা থেকে সংগ্রহ করেছি। অনেক উপকৃত হয়েছি। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। তিনি বললেন, ধন্যবাদের কিছু নেই। আপনার এই বইটিও হিন্দিতে প্রকাশ করতে পারেন। আমার বই হিন্দিতে প্রকাশ করেছে এমন একটি ভালো প্রকাশক আছেন। যদি রাজি হন তাহলে দিল্লিতে আসুন বিপুলকে নিয়ে।
জাপানে ফোন দিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করলে বলল, এটা তো সুসংবাদ। দিল্লি যাও দেখো প্রকাশক কী বলেন।
দিল্লি গেলাম, বিপুল নিয়ে গেল। কয়েকদিন ছিলাম সালাম ভাইয়ের বাসায়। তখন মনে হয় সোহেলি ভাবীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ভাবী যেমন সুন্দরী তেমনি অমায়িক ব্যবহার। আর তাদের রাজকীয় আতিথেয়তা কোনোদিন ভুলবার নয়। একদিন দুপুরে প্রকাশককে ডেকে আলাপ করা হল। প্রকাশক রাজি হলেন, জাপান বলে কথা! জাপানের হিরোশিমা নিয়ে একটি মাত্র বই প্রকাশিত হয়েছে আর কোনো বই নেই! বাংলা থেকে পাণ্ডুলিপি কলকাতার একজন স্বনামধন্য মহিলা অনুবাদককে করানোর দায়িত্ব বিপুলকে দিয়ে জাপানে ফিরে এলাম।
পরের বছর বইটি প্রকাশিত হল দিল্লির ‘প্রকাশন সংস্থান’ প্রতিষ্ঠান থেকে। পরে অবশ্য মূল বাংলাটি ঢাকা থেকে বের হয়েছিল ২০০৮ সালেই। সালাম ভাই আগ্রহী না হলে এমন সুযোগ আমার জীবনে কোনোদিন আসত না বলাই বাহুল্য।তাকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। বিপুলকে অশেষ ধন্যবাদ।
কিছুদিন আগে ‘প্রতীচী’ নামে একটি ম্যাগাজিন নিয়ে আলোচনাকালে সালাম ভাই তথা সালাম আজাদ সম্পর্কে লিখেছিলাম। অসামান্য মেধাবী ইতিহাসপ্রিয় একজন লেখক তিনি। সেইসঙ্গে একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। মানবাধিকার আ্ন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিদেশে গিয়েছেন একাধিকবার বিভিন্ন সেমিনারে।
২০১১ সালেও পুনরায় দিল্লিতে তার বাসায় আতিথ্যগ্রহণ করেছিলাম। সেবার গুণদা তথা নির্মলেন্দু গুণও ছিলেন। জমজমাট আড্ডা হয়েছিল আমাদের। বিপুলও ছিল। সেবার সালাম ভাই সারারাত ধরে বলেছিলেন তার বিখ্যাত দুটি বড় গ্রন্থ যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে লিখিত প্রামাণ্য ইতিহাস (Contribution of India in the War of Liberation of Bangladesh এবং Role of Indian People in Liberation War of Bangladesh), কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করে, সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ভারতীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে লিখেছেন। অসামান্য মূল্যবান গ্রন্থ না বললেও চলে।
আমরা অনেকেই জানি না যে দুই দেশের কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনেক। কিন্তু তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। বাংলাদেশে মূল্যবান কাজের মূল্যায়ন হয় না।
সেই সালাম ভাই গতকাল রাতে হঠাৎ করে ফোন দিয়ে চমকে দিলেন আমাকে! তিনি এখন জাপানে। আজকে হিরোশিমা গেলেন। শুক্রবার টোকিও ফিরে সেইদিনই বাংলাদেশে চলে যাবেন। দেখা হল না ব্যস্ততার কারণে। বড় আক্ষেপ রয়ে গেল।
সামনে ঢাকায় দেখা হবে সালাম ভাই। আড্ডা হবে, কথা হবে। ভালো থাকুন। অনেক অনেক প্রীতি ও ধন্যবাদ জানবেন।