Site icon দ্বিপ্রহর ডট কম

জাপানে দরিদ্র আর ধনীর মধ্যে জীবিকার মানের তফাৎ

আশির আহমেদের ধারাবাহিক রচনা…..

জাপানে গরীব লোক চোখে পড়েনা।
কেন পড়েনা? প্রফেসর ইউনুসের সামাজিক ব্যবসা নিয়ে গবেষণা করছেন এমন এক জাপানি অর্থনীতিবিদকে জিজ্ঞাস করতেই সে উল্টা প্রশ্ন করে বসল-

তোমাদের দেশে একটা কোম্পানির কর্মচারিদের স্যালারি গ্যাপ কত?
আমি আমতা আমতা করছি। একজন পিয়ন আর বড়কর্তার বেতনের মধ্যে তফাৎ হিসাব করছি।

উনি বললেন- জাপানে গড়ে ১০ গুণ। চায়না তে ৪০ থেকে ২০০ আর আমেরিকা তে ১০০০ গুণ।

আয়ের তফাৎ যত কম হবে দধিফাৎ তত কম হবার কথা।
কিন্তু কমাবার উপায় কী?

এই প্রশ্ন ক্লাস সেভেন এর একটা ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে –
(ক) গরীবদের আয় বাড়ান
(খ) ধনীদের নিজ দেশে খরচ বাড়ান

কীভাবে?

(১) জাপানিরা দেড়শ বছর আগে (১৮৬৮) সিদ্ধান্ত নিলেন – এই দেশে নিম্ন আয়ের কোন লোক রাখবেন না।
মানে কি? বিদেশে পাঠিয়ে দেবেন?
আরে নাহ।

এলগোরিদমটা হল- বেশি বেশি আয় করো, বেশি বেশি ব্যয় করো। টাকার গতি বাড়াও। অর্থনীতি চাঙ্গা করো।

আপনি জাপানে জুতা পালিশ করাবেন? ১০-২০ ডলার। চুল কাটাবেন? একজন নাপিতের গড় আয় কত জানেন? মাসে ২০০০ ডলার। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়াতে যারা রান্না করে দিচ্ছেন – ওনাদের গড় বেতন ও ২০০০ ডলার এর কাছাকাছি।তাহলে গরিব কারা ?

উচ্চ আয়ের লোক তৈরি করতে কোয়ালিটি লোকবল লাগে। ১৮৬৮ সালেই কোয়ালিটি লোকবল তৈরি করতে নেমে গেলেন। প্রথমেই জোর দিলেন শিক্ষার উপর। ১৯০০ সালে এই দেশে শিশু শিক্ষার হার ছিল ৯০% [১]।

যে নাপিত আপনার চুল কাটছে, ক্যাফেটেরিয়াতে যে খালাম্মা রেঁধে দিচ্ছে – তারা ইউনিভার্সিটি পাস না হলে ও কমপক্ষে কলেজ পাশ করে হেয়ার ড্রেসিং/ রান্নার উপর ডিপ্লোমা করেছে। গেটের দারোয়ান বলেন, ট্যাক্সি ড্রাইভার বলেন সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা একই লেভেল এর। দক্ষ শ্রমিক দিয়ে কাজ করালে কোয়ালিটি তো ভাল হবে না ?

১৯৪৫ সালের যুদ্ধ বিধ্বস্ত এক দেশ জাপান। উল্লেখযোগ্য কোন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। ছিল শুধু শিক্ষিত জনগোষ্ঠী আর গ্রুপ ওয়ার্কিং এর কোয়ালিটি। ২০ বছরের মাথায় ১৯৬৪ সালে টোকিও অলিপম্পিক আয়োজন করলো। চাট্টি খানি কথা নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন শিনকানসেন ওসাকা-টোকিওর মাঝখানে চালিয়ে দেখিয়ে দিল। শিনকানসেন এর লাইন টানতে হল পাহাড়ের মধ্য দিয়ে, সমুদ্রের নীচ দিয়ে। সুড়ঙ্গ বানাতে হলো। টোকিও থেকে ফুকুওকা ট্রেনে আসতে হলে আপনাকে সমুদ্রের নীচ দিয়ে আসতে হবে। হোক্কাইদো যাবেন? সমুদ্রের নীচ দিয়ে যেতে হবে। মজার ঘটনাটি হচ্ছে বিদেশ থেকে কোন শ্রমিক আমদানি করে নি। যে ইঞ্জিনিয়ার সেই শ্রমিক। ৪০ বছর পর ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স এর মধ্যে ইংলিশ চ্যানেলে সুড়ঙ্গ তৈরি করতে জাপানের ডাক পড়লো।

আমাদের দেশে জাপানিরা যে সমস্ত সেতু, সার কারখানা গুলো বানিয়েছেন সেখানে বাংলাদেশের শ্রমিকরা জাপানের ইঞ্জিনিয়ারদের এই শ্রমিকগিরি তে আশ্চর্য হয়েছেন।

(২) ২০১০ সালের কথা। একটা কনফারেন্স এর কাজে স্কটল্যান্ড গিয়েছিলাম। ওখানকার স্বনামধন্য একজন বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ গ্লাসগো শহরখানা দেখালেন। ৪০০-৬০০ বছর পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০ বছর আগের তৈরি সিটি অফিস, পানি বণ্টন ব্যবস্থা, পাতাল রেল স্টেশন।
সামান্য কৌতুকের সুরে বললেন, এরা আমাদের দেশ থেকে কর নিয়েছে, তা খরচ করেছে জনগণের জন্য – শিক্ষার জন্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য।
আমাদের সম্রাট শাহাজাহান ও কর নিয়েছেন, বানিয়েছেন তাজমহল। নিজের জন্য। জনগণের জন্য নয়।
দধিফাৎ কমবে কেমনে?

(৩) চারশো বছর আগে সায়েস্তা খাঁ টাকায় আটমন চালের মূল্য নির্ধারন করে দিলেন। আমরা এখনো গর্বের সাথে এই ইতিহাস পড়ি। তখনকার মানুষ বুঝি সস্তায় চাল কিনে সুখে শান্তিতে বসবাস করতেন। ব্যাপারটা আমি দেখি অন্য ভাবে। ক্রেতারা শান্তিতে থাকলে ও কৃষকরা শান্তিতে ছিলেন না।
১ টাকা আয় করার জন্য একজন কৃষকের ৮ মন চাল অর্থাৎ ১৪ মনের মত ধান তৈরি করতে হতো। কৃষকের আয় বাড়বে কিভাবে?

আমরা পিজা খেতে গিয়ে বখশিশ দেই একরকম, ট্যাক্সি ড্রাইভারকে একরকম আর রিকশাওয়ালা কে একরকম। শ্রম কে বেশী দিচ্ছে, কার বেশি পাওয়া উচিৎ? তেলা মাথায় তেল বেশি ঢালা হচ্ছে।
দধিফাৎ বাড়িয়ে দিচ্ছি না?

(৪) ফেসবুকে মাঝে মাঝে একটা বাণী দেখি, বিল গেটস নাকি বলেছেন-
“গরীব হয়ে জন্মানোর দোষ তোমার না,
কিন্তু গরীব হয়ে মৃত্যু হলে সেই দোষ তোমার”।

এটার আবার একটা প্যারোডি ও আছে-
“বাপ গরীব হলে এই দোষ তোমার না
কিন্তু শ্বশুর গরীব হলে এই দোষ তোমার“।

ধনী হবার জন্য কি লাগে? তাবিজ? কর্মদক্ষতা? পড়াশুনা? ভাগ্য? সরকারের পদক্ষেপ?

মনে হয় সব গুলোই লাগে। ভাগ্যকে অবিশ্বাস করি কীভাবে? আমাদের গ্রাম থেকে যারা বিদেশে গেছেন, তারা অনেকেই শর্টকাটে ধনী হয়েছেন।

গ্রামের একই ক্লাসের রহিম আর করিম একই রেজাল্ট নিয়ে এস, এস, সি পাস করে একই দালাল কে একই পরিমাণ টাকা দিয়ে গ্রাম থেকে বিদেশে রওয়ানা দিল। রহিম মালয়েশিয়াতে কাজ করে বাড়িতে ফ্রিজ টিভি কিনেছে, ঈদের দিনে পরিবারের সবাই ভাল কাপড় চোপড় কিনে দিয়েছে। ছোট বোনকে ভাল বিয়ে দিয়েছে। আর করিম নিখোঁজ। হয়তো রোহিঙ্গাদের সাথে ভাসছে। এই দধিফাতের কারণ কি? ভাগ্য ছাড়া আবার কি?

(৫) দধিফাৎ বের করার জন্য একটু পড়াশুনা শুরু করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজমুল স্যার বলল- আশির ভাই, GINI স্কোরটা দেখেন GINI স্কোর।

এইডা আবার কি?
একটা দেশের সম্পদ তার জনগণের মধ্যে কতটুকু ফেয়ারলি ডিস্ট্রিবিউট করা আছে, তা বুঝা যায়।

তো ?
যে দেশের GINI স্কোর যত বড়, সেই দেশে দধিফাৎ তত বেশি। ধরুন, আপনার দেশের সম্পদ হল ১০ টাকা আর জনসংখ্যা ১০। আপনার দেশের সব নাগরিক যদি ১ টাকার সম্পদ উপভোগ করতে পারে তাহলে আপনার দেশের GINI স্কোর সবচেয়ে কম।

আমার এক প্রাক্তন কলিগ পার্থ ঘোষ বলতেন – আশির ভাই, দুর্নীতি-যুক্ত দেশ গুলোতে আয় দিয়ে জীবিকার মানের তফাৎ পাবেন না। আপনাকে দেখতে হবে এক্সপেন্ডিচার প্যাটার্ন। মানুষ কিভাবে ব্যয় করছে সেটা দেখেন। বাংলাদেশে আমার বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে শিক্ষক আছেন, পুলিশ আছেন, মন্ত্রী আছেন, ভিক্ষুক আছেন, ব্যবসায়ী আছেন- মনে মনে ওনাদের মাসিক আয় ও ব্যয় কল্পনা করলাম। সত্যিই আয় আর ব্যয়ের প্যাটার্ন মিলছে না। দধিফাৎ কেবলই বড় মনে হয়।

আজকাল ঈদ এর ছুটি কাটাতে অনেকে সপরিবারে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর যান। ভারতে বাংলাদেশিরা নাকি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কাস্টোমার। ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে কোন লিস্ট থাকলে আমাদের র‍্যাঙ্কিং টা আরো এক ধাপ এগুতো।

এমনিতেই জি,ডি,পি/ জি,এন,পি জাতীয় পদার্থ গুলো আমার অপছন্দের। এগুলো দেখলে নিজের দেশকে গরিব মনে হয়। ভাল্লাগেনা। পৃথিবীতে কি আর কোন ইনডেক্স নেই যেখানে আমরা উপরে আছি?

অমর্ত্য সেনের একটা বই পড়ছিলাম। Mismeasuring our lives: why GDP does not Add up। জি,ডি,পি নয়, উনি সোশাল প্রগ্রেস ইনডেক্স নামের আরেকটা ইনডেক্স প্রস্তাব করছেন [২] । সেই ইনডেক্সে বাংলাদেশের স্থান ১০০, ভারত আমাদের চেয়ে এক দাগ পিছিয়ে, ভারতের স্থান ১০১। কেমন যেন বুকটা একইঞ্চি ফুলে গেল।

ক্রিকেটে যেদিন বাংলাদেশ ইংল্যান্ড কে হারিয়ে দিল, তার কয়েকদিন পর এক বৃটিশের সাথে দেখা।
আমি বুকটাকে দুই ইঞ্চি ফুলিয়ে বললাম- কিরে লর্ড ক্লাইভের নাতি, দিনকাল কেমন যাচ্ছে? সে ক্রিকেটের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল। যেন এই খেলা সে চেনে না।

(৬) আমি আন্ডারগ্রাজুয়েট করেছি জাপানে। আমার জাপানি ক্লাসমেটসরা সবাই পড়াশুনা শেষ হবার আগেই চাকুরীতে সাইন করলো (কয়েকজন মাস্টার্স এ ঢুকল)। বর্তমানে সবারই লাইফ লাইন স্টেবল- গাড়ি, বাড়ি থাকার কথা। দধিফাৎ শূন্যের কাছাকাছি। সমাজের এই অবকাঠামো এমনিতেই তৈরি হয়নি, কেউ তৈরি করে দিয়েছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমাদের সাথে ক্যাফেটরিয়াতে লাইন ধরে একই মেন্যুতে লাঞ্চ করেন। অফিসে ওনার জন্য আলাদা কোন টয়লেট নেই। সবার জন্য যা ওনার জন্য ও তা। গাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সময় ওনাকে ও আইডি কার্ড পাঞ্চ করতে হয়। এদের দধিফাৎ কমবে না তো কাদের কমবে?

(৭) কয়েকদিন আগে জাপানের টি,ভি তে ভুটান দেখাল। গরীবের গ ও নেই। অথচ ছোটকালে পড়েছি পৃথিবীর সবচেয়ে গরীব দেশ ভুটান। আমরা ছিলাম দ্বিতীয়। তাদের সরকার GDP দেখছেন না, দেখছেন GNH (Gross National Happiness) [৩]।
সরকার সুখী জনগণ তৈরি করতে চান। সুখ কে সংজ্ঞায়িত করেছেন। পরিবেশের উপর নজর দিয়েছেন। সবচেয়ে পরিবেশ বান্ধব গাড়ি ব্যবহার করছেন। জাপানের নিসসান কোম্পানির সি,ই,ও নিজে গেলেন ভুটানে। লিফ নামের তেলবিহীন বিদ্যুৎ চালিত গাড়ির মার্ক্টেটিং করে এলেন। ৫ বছরের মধ্যে সংখ্যায় এরা পৃথিবীর সবচেয়ে পরিবেশ-বান্ধব গাড়ি ব্যবহার করবেন। এমন ক্যাম্পেইন এ নেমেছেন।

(৮) ইসলাম যাকাতের কথা বলে। আপনার সঞ্চিত সম্পদের আড়াই শতাংশ সম্পদ নিকটতম দরিদ্র ব্যাক্তিটিকে দিন। এমন ভাবে দিবেন যেন আগামী বছর উল্টা সে যাকাত দিতে সক্ষম হয়। যাকাতের টাকাগুলোর বণ্টন পদ্ধতি নিয়ে কোন গবেষণা আছে?

সামনের মাসে ঈদ। বাংলাদেশে ঈদের দিনে দধিফাৎটা ভিজিবল হয়ে উঠে।

Exit mobile version