বিশ্বকাপ বড় লম্বা এক যাত্রা। শুধু এক ম্যাচ জিতলেই চলছে না। নয় ম্যাচে ভালো করতে হলে চাপ নিতে শিখতে হবে, চাপের মুখে খেলতে হবে। সে হিসেবে প্রথম ম্যাচেই ভালো প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ। ৩৩০ রান নিয়েও ম্যাচে অনায়াস জয় পায়নি। ৪৮তম ওভারের প্রথম বলে গিয়ে টের পাওয়া গেল, বাংলাদেশ ম্যাচটা জিততে যাচ্ছে! প্রথমবারের মতো বুকের কাঁপনটা নিয়ন্ত্রণে আনার সুযোগ পেল বাংলাদেশের সমর্থকেরা।
বিশ্বকাপে কোনো দল কখনো ৩৩০ তারা করেনি। সর্বোচ্চ ৩২৯ করে জিতেছিল আয়ারল্যান্ড। সেই ২০১১ সালে, কেভিন ও’ ব্রায়েনের পাগলাটে এক সেঞ্চুরি স্তব্ধ করে দিয়েছিল ইংল্যান্ডকে। সে তুলনায় আজ যখন প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ ৩৩০ করেছিল, তখনই তো বাংলাদেশের জয়টা নিশ্চিত ধরে নেওয়া যেত। কিন্তু ওই যে বাংলাদেশ চাপ সয়ে ম্যাচ জেতার প্রস্তুতিতে নেমেছিল। সেটা সয়েই আজ পেল ২১ রানের জয়। উপমহাদেশের একমাত্র দেশ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একাধিক জয় শুধু বাংলাদেশের। এ তথ্যটাও তৃপ্তি দেবে সবাইকে।
সাধারণত জয় পরাজয়ের পার্থক্য বিভিন্ন ঘটনায় টের পাওয়া যায়। আজ অমন সব ঘটনা সবই ঘটেছে, কিন্তু সেগুলো বাংলাদেশের জয়ের কথা বলছিল না। ক্যাচগুলো সব বারবার হাতের নাগালের একটু বাইরে পড়ছিল, ফিল্ডিংয়ে অমার্জনীয় ভুল দেখা গেছে। মাশরাফি নিজের বোলিং কোটা পূরণ করতে পারেননি। পুরো ইনিংস জুড়েই কিছু শব্দ কানের কাছে অনুরণিত হয়েছে, ‘আহা, উঁহু।’ রান আউটের সুযোগ এসেছে বারবার। কিন্তু বারবার সে সব সুযোগের পর ওই শব্দ যুগলই ব্যবহার করতে হলো, ‘আহা, উঁহু।’
ভাগ্যের সঙ্গে যদি লড়তে না পারা যায় তবে বিশ্বকাপে খেলতে আসা কেন! তাই নিজেরাই নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে নিয়েছে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের উইকেটে মোস্তাফিজের পুনর্জন্ম হলো বিশ্বকাপের অভিষেক ম্যাচেই। চোট শঙ্কা কাটিয়ে সাইফউদ্দীন ফিরলেন, তুলে নিলেন অতি মূল্যবান দুটি উইকেট। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব দেখালেন তাঁর সেরাটা।
এ ম্যাচেও ম্যাচ সেরার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ব্যাট ও বলে দারুণ পারফরম্যান্সে সেটা অবশ্যই সাকিবের কাছে গেছে। বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা চার বিশ্বকাপেই প্রথম ম্যাচেই ফিফটি করেছেন। কিন্তু বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডার ওতেই সন্তুষ্ট হন কীভাবে? যখনই মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ ম্যাচ থেকে ছিটকে যাচ্ছে, তখনই এইডেন মার্করামকে (৪৫) ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের আশা ফিরিয়ে এনেছেন।
কিন্তু এ ম্যাচের গল্পে মোস্তাফিজুর রহমান থাকবেন, থাকবেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দীন। বাদ পড়বেন না মেহেদী হাসান মিরাজও। চার ছক্কাকে মামুলি ব্যাপার বানিয়ে দেওয়া ডেভিড মিলার (৩৮) ও ক্রিস মরিসকে ফিরিয়ে রানের স্রোত আটকেছেন মোস্তাফিজ। ওতেও যখন কাজ হচ্ছিল না, একদম শেষ দিকে পথের কাটা হয়ে ওঠা জেপি ডুমিনির (৪৫) স্টাম্প নড়িয়ে সেই মোস্তাফিজই বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করলেন। সাইফউদ্দীনকেও কীভাবে পিছিয়ে রাখবেন? ফর্মে থাকা ফন ডার ডুসেন (৪১) ও ফিকোয়াওকে ফিরিয়ে দিয়ে অবিশ্বাস্য লম্বা দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইনআপকে একটু কমিয়ে এনেছেন তো ওই সাইফউদ্দীন।
উইকেট তুলে নেওয়ায় হয়তো পিছিয়ে আছেন মিরাজ। কিন্তু ৩৩০ রানের ম্যাচে ১০ ওভারে শুধু ৪৪ রান দিয়েই নায়ক বনে যেতে পারতেন মিরাজ। এই অফ স্পিনার খালি হাতে যাননি, ৫৩ বলে ৬২ করা প্রোটিয়া অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসিকে ইনিংসের মাঝপথে না ফেরালে আজকের জয়টা হয়তো অসম্ভবই থেকে যেত। ব্যাটিংয়েও বহুদিন পর দলের সবাই কিছু না কিছু অবদান রেখেছেন বলেই না শুধু বিশ্বকাপ নয় ওয়ানডেতেই নিজেদের সর্বোচ্চ স্কোরটা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
বিশ্বকাপ নিয়ে নিজেদের স্বপ্নটা উচ্চারিত হতে দিচ্ছে না দল। আড়ালে আবডালে সেমিফাইনালের রব শোনা যায়, আবার সেটা আড়াল করে দিতে কঠিন ফরম্যাট, কন্ডিশন আর নানা চাপের থিওরিও কপচানো হয়। কিন্তু আজ বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আগ্রাসন, বোলারদের স্নায়ুচাপ সয়ে বল করা আর ভাগ্যকে প্রতিপক্ষ পেয়েও লড়ে যাওয়াই বলে দিচ্ছে স্বপ্নটা ঠিকই দেখছে বাংলাদেশ। আর দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দিয়ে সে স্বপ্নের কথা চিৎকার করেই জানিয়ে দিল বাংলাদেশ দল।