বিশ্বের ধনী দেশগুলোয় কর্মসংস্থান বাড়ছে। পুঁজিকেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামো নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠছে, তখন চাকরির বাজার–সম্পর্কিত এ তথ্য একধরনের আশ্বাস দিচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। কিন্তু এই আশ্বাসের ওপর ভরসা করা যায় কতটা, তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন। কারণ, পুঁজির কাঠামোটি নিয়ে মূল প্রশ্নটি চাকরির বাজার নয়, বাজার এবং এই বাজারে বিদ্যমান বৈষম্য।
কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে কর্মীর একধরনের অম্লমধুর সম্পর্ক থাকে। কাজের ক্ষেত্রটি যেমন তাকে বেঁচে থাকার রসদ জোগায়, তেমনি অত্যধিক কাজের চাপে তাকে পিষ্টও করে। সময়ের সঙ্গে এই চাপ ক্রমাগত বাড়ে। কিন্তু এর সঙ্গে সমভাবে বাড়ে না আর্থিক যোগ—এমন অভিযোগ কিংবা অনুযোগের দেখা পাওয়া যায় সব ক্ষেত্রের সব স্তরের কর্মীর মধ্যেই। বলা হয়, কাজের ক্ষেত্র একজন মানুষের জীবন থেকে ‘ব্যক্তিগত’ বিষয়টিকেই মুছে ফেলে। সঙ্গে যোগ করে অনিশ্চয়তা। প্রযুক্তির উল্লম্ফনের কারণে আজকের দুনিয়ায় কোনো কিছুই আর ব্যক্তিগত থাকছে না। সে অন্য আলাপ।
এটিই হচ্ছে মোটাদাগে পুঁজিকেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামোয় কর্মী মাত্রই বাস্তবতা। কিন্তু এই বাস্তবতাকেই একটি প্রকল্পিত শঙ্কার ছক হিসেবে উপস্থাপন করছে কিছু পরিসংখ্যান। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত মে মাসে তাদের কর্মসংস্থান প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে ইইউভুক্ত ২৮ দেশেই কর্মসংস্থান বৃদ্ধির তথ্য উঠে এসেছে। অঞ্চল হিসেবে ধরলে ইউতে বেকারত্বের হার বর্তমানে গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু তা-ই নয় বেড়েছে মজুরিও। যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন তো অনেক আগে থেকেই সর্বনিম্ন বেকারত্বের হার নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও এই প্রচারে তুলে ধরা তথ্য নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। সে কথায় পরে আসি।
ধনী দেশগুলোর জোট অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) দেশগুলোয় দুই-তৃতীয়াংশই চাকরির সুযোগ বাড়ছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোয় বিশেষত ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের জন্য স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। জাপানের ক্ষেত্রে এ বয়সীদের ৭৭ শতাংশই কোনো না কোনো কাজে রয়েছে। ব্রিটেন ও জার্মানিরও একই অবস্থা। এমনকি ফ্রান্স, স্পেন ও ইতালিতে বেকারত্ব তুলনামূলক উচ্চ হলেও ইতিবাচক পথেই রয়েছে। বর্তমান ধারা বজায় থাকলে খুব শিগগির দেশগুলো ২০০৫ সালের পর্যায় পেরিয়ে যাবে।
চাকরির বাজার বিচারে পরিসংখ্যানগত জায়গায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে বর্তমানে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যা গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সঙ্গে নতুন ২ লাখ ৬৩ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। দুটিই গত এপ্রিল মাসের সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী। বিষয়টিকে পুঁজি করে দেশটির প্রশাসন ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু এই প্রচারের সঙ্গে ঠিক মিলছে না অন্য তথ্যগুলো। কারণ, একই বিষয়ে করা আরেক জরিপ কারেন্ট পপুলেশন সার্ভের (সিপিএস) তথ্য বলছে, এই নতুন চাকরির মধ্যে ১ লাখ ৫৫ হাজার খণ্ডকালীন ও স্বেচ্ছাসেবামূলক। অর্থাৎ সিপিএস বলছে, নতুন যে চাকরিগুলো সৃষ্টি হয়েছে, তার অর্ধেকের বেশি দ্বিতীয় বা তৃতীয় কর্মক্ষেত্র হিসেবে নিতে পারেন চাকরিপ্রার্থীরা। সিপিএসের দ্বিতীয় আরেকটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে আরও ভয়াবহ তথ্য। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী চাকরির সংখ্যা গত মাসে বরং কমেছে। কতটা কমেছে? এপ্রিল মাসে স্থায়ী চাকরির সংখ্যা ১ লাখ ৯১ হাজার কমেছে। এর আগের মাসে কমেছিল ২ লাখ ২৮ হাজার। অর্থাৎ স্থায়ী চাকরির সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে আদতে ধারাবাহিকভাবেই কমছে।
অনলাইন সাময়িকপত্র কাউন্টারপাঞ্চে এ–সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব তথ্যকে আড়ালে রেখে মার্কিন প্রশাসন মূলত বেকারত্ব হ্রাসের তথ্যটিই ফলাও করে প্রচার করছে। একই সঙ্গে বলা হচ্ছে, এই বেকারত্বের হার স্থায়ী চাকরির বিচারের হিসাবে করা হয়েছে। অথচ স্থায়ী চাকরির হার যেখানে ১ লাখ ৯১ হাজার কমছে, সেখানে খণ্ডকালীন চাকরির সংখ্যা বাড়ছে ১ লাখ ৫৫ হাজার। সে ক্ষেত্রে স্থায়ী চাকরির সংখ্যা কমলে একই সঙ্গে সেই বিবেচনায় হিসাব করা বেকারত্বের হার কী করে কমে, সে প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই ওঠে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ধনী দেশগুলোয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়টি মূলত গত দশকে হওয়া মন্দার ফলাফল। অর্থনৈতিক মন্দার সবচেয়ে বড় প্রভাবটি পড়েছিল ধনী দেশগুলোর ওপরই। মন্দা কাটিয়ে ওঠার সময় যে উদ্দীপনামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম নেওয়া হয়, তারই ফল পেতে শুরু করেছে ওই দেশগুলো। পাশাপাশি রয়েছে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের বিষয়টিও। আগের চেয়ে প্রযুক্তি অনেক উন্নত হওয়ায় চাকরিবিষয়ক ওয়েবসাইটগুলো এখন খুব সহজেই বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞাপনের সঙ্গে উপযুক্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংযোগ ঘটিয়ে দিতে পারছে। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংযোগটি তৈরি হচ্ছে সহজে, যা বেকারত্ব হ্রাসে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। যদিও প্রযুক্তি বিশেষত রোবট প্রযুক্তির উন্নতিকে চাকরিপ্রার্থীরা ভয়ের চোখে দেখেন। একটা প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, প্রযুক্তির উন্নতির কারণে মানুষ প্রচুর কাজের ক্ষেত্র হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। দেখা যাচ্ছে, একদিকে সত্যিই সংকোচন হলেও অন্যদিকে চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। চাকরি মিলবে কি মিলবে না, তা মূলত নির্ভর করছে সময়ের সঙ্গে নিজেকে প্রস্তুত করার ওপর। আর এখানেই রয়েছে অনিশ্চয়তার প্রসঙ্গটি। অর্থাৎ আধুনিক প্রযুক্তি ও পুঁজির অনিঃশেষ ক্ষুধা—দুই মিলে চাকরিজীবী ও চাকরিপ্রার্থী—দুইকেই চোখ রাঙাচ্ছে। এক সীমাহীন দৌড়ে নামতে হচ্ছে সবাইকে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসংস্থান তথ্য যেমন বলছে, মোটাদাগে চাকরির সুযোগ বাড়লেও কমছে স্থায়ী চাকরির সুযোগ। অর্থাৎ কর্মীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কমে যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি আর সামনে আনতে রাজি নন শাসকেরা। তাঁরা কিছু পরিসংখ্যান দেখাতে চান। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো অবশ্য এটি দেখাতে পারছে না। তারা দেখাচ্ছে ‘সম্ভাবনা’। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার এখন হতাশাজনক পর্যায়ে রয়েছে। সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন এ কথাই প্রমাণ করে। এর বাইরে যদি দেশীয় পরিসংখ্যান ঘাঁটতে হয়, তাহলে উঠে আসবে আরও ভয়াবহ তথ্য। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রতিবেদন বলা হয়, বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, এ হার ৮৬ শতাংশ। সরকারি হিসাব আমলে নিলেও তা যথেষ্ট হতাশাজনক। কারণ, অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান কর্মীকে নিরাপত্তা দিতে পারে না।
আবার আসা যাক ধনী দেশগুলোর দিকে। সেখানে কাজের ক্ষেত্র বাড়ছে, বেকারত্ব কমছে বলে যে প্রচার করা হচ্ছে, তার অন্তর্গত সংকটটি বুঝতে হলে তাকাতে হবে স্থায়ী চাকরির সুযোগের দিকে। মোটাদাগে চাকরির সুযোগ বাড়লেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আদতে স্থায়ী চাকরির সুযোগ কমছে। উন্নত প্রযুক্তির কারণে উৎপাদন খাতের একটি বড় অংশই চলে গেছে মানুষের নাগালের বাইরে। ফলে অচেনা কাজের ক্ষেত্রের দিকে যেতে হচ্ছে সেসব দেশের মানুষকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ব্যক্তিগত সহকারীর কথা। প্রযুক্তি এখন পদটি নিয়ে নিচ্ছে। এর বদলে খুলছে হোমকেয়ারের মতো চাকরির সুযোগ, যা আদতে একটি ঠিকা কাজ, কখন চলে যাবে, তার কোনো ঠিক নেই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মূলত কর্মীর ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে। নতুন প্রযুক্তি ও কাজের নতুন ধারার সঙ্গে নিজেকে সমন্বয় করতে হচ্ছে। না পারলেই ছাঁটাই। বিষয়টি বুঝতে পেরেই ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন কিছুদিন আগে বলেছেন, ‘আমাদের চাকরির বাজার অনিশ্চয়তার এক সমুদ্রে পরিণত হয়েছে।’
ইকোনমিস্টই জানাচ্ছে, কাজের ক্ষেত্র মূলত বাড়ছে উচ্চ দক্ষতা ও অদক্ষ ক্ষেত্রগুলোয়। মাঝারি দক্ষতার কাজ খুঁজে পাওয়া দিন দিন কঠিন হচ্ছে। সাময়িকীটির এ তথ্য বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় তা হলো উচ্চ মজুরি ও নিম্ন মজুরির কাজই বাড়ছে মূলত। নিম্ন মজুরির কাজের আবার একটি বড় অংশই অস্থায়ী। আবার উচ্চ মজুরির কাজ মিলছে সমাজের গুটিকয় ব্যক্তির; বিপরীতে অগণিত ছুটছে নিম্ন মজুরির দিকে। ফলে কাঠামোগতভাবেই বৈষম্যের পালে হাওয়া লাগছে। এই বৈষম্যের কথা অনেক দিন ধরেই শুনছে বিশ্ব। ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট তো বেশি দিন আগের নয়। এই বৈষম্য দিন দিন আরও বেশি করে বাস্তব হয়ে উঠছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আর্থিক সেবাপ্রতিষ্ঠান ক্রেডিট সুইসের রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ওয়ার্ল্ড ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৫ অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষ এখন বিশ্বের ৫০ শতাংশ সম্পদের মালিক। আর ৫০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ মাত্র ১ শতাংশ সম্পদের মালিক। কিন্তু ধনী দেশগুলোর কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসম্পর্কিত প্রতিবেদনে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে ইকোনমিস্ট। কারণ, এখানেই রয়েছে শুভংকরের ফাঁকিটি।
পুঁজি বরাবরই ‘চুইয়ে পড়া নীতির’ কথা বলে আসছে। বৈষম্যের কথা তুললেই তারা শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির সর্বশেষ তথ্যটি সামনে হাজির করে। কিন্তু সমাজের উঁচু স্তরের আয়ের হিসাব, কিংবা বাজারের গতিপ্রকৃতির বিষয়টি তারা এড়িয়ে যায়, যেন এ দুটির মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। ইইউ থেকে শুরু করে ধনী সব কটি দেশ কর্মসংস্থানের তথ্যকে এই সময়ে এমনভাবে সামনে আনছে, যেন এটাই একমাত্র মোক্ষ। এটা অনেকটা মাথাপিছু আয়ের মতো বিষয়। মাথাপিছু আয় এমন এক ভাঁওতা, যা দিয়ে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের বুকে একটু গৌরবের হাওয়া দেওয়া যায়। অনেকটা কাজির গরুর মতো অবস্থা, যা কাগজে আছে গোয়ালে নেই। কর্মসংস্থান বাড়ছে বা চাকরির বাজারের ভালো অবস্থার পরিসংখ্যানভিত্তিক তথ্যও অনেকটা এ রকম, যা চাকরিপ্রার্থীদের ভুলে থাকতে সহায়তা করে। তারা কাজের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়ার বদলে ‘সম্ভাবনাকে’ পাশবালিশ করে যেন ঘুমোতে পারে। আর এটিই পুঁজির অধিপতিদের আরও আরও উঁচুতে ওঠার সুযোগটি দেয়।
ফজলুল কবির: সাংবাদিক