Site icon দ্বিপ্রহর ডট কম

জাপানি সাউন্ড প্রুফ হাইওয়ে

আশির আহমেদের ধারাবাহিক জাপান কাহিনী-

জাপানের অধিকাংশ হাইওয়ে গুলো তৈরি হয় ১৯৫৬ সালে। আজ থেকে ৭৩ বছর আগে। হাইওয়ে মানে কোন ট্রাফিক সিগন্যাল থাকবে না। সাঁই সাঁই করে সুপার স্পিডে গাড়ী চলবে।

বিপাকে পড়লেন রাস্তার দুপাশের অধিবাসীরা। সরকারের কাছে নালিশ দিয়ে বসলেন- “আওয়াজের জ্বালায় ঘুমাতে পারিনা। রাস্তা সরান”।

রাস্তা সরানো চাট্টি খানি কথা নয়। সরকার বুদ্ধিজীবীদের ডাকলেন। পরামর্শ চাইলেন। উদ্দেশ্য হলো “কত আওয়াজে কত জ্বালা” তা পরিমাপ করা।

আওয়াজ পরিমাপের পদ্ধতি জানা ছিল। টেলিফোন যিনি আবিষ্কার করেছিলেন, গ্রাহাম বেল সাহেব, উনি আওয়াজ পরিমাপ করার কৌশল ও আবিষ্কার করেছিলেন। আগেকার আমলে আবিষ্কারকের নামে পরিমাপের একক রাখা হতো। যেমন বল (ফোর্স) এর একক নিউটন, চাপ এর একক পাস্কাল।

গ্রাহাম বেল সাহেবের নামে আওয়াজ পরিমাপের একক হলো বেল। এক বেল, দুই বেল ইত্যাদি। এক বেল অনেক বড় বলে দশভাগের এক ভাগে নামিয়ে একক তৈরি হলো। ডেসি-বেল [dB]। এক বেলের এক দশমাংশ।

বলছিলাম কত আওয়াজে কত জ্বালা তা পরিমাপের কাহিনি। বুদ্ধিজীবীরা সরকার কে বুদ্ধি দিলেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ বিভিন্ন বয়সের ২০০ জন অধিবাসীদের ওপর সমীক্ষা চালালেন। শব্দহীন রুমের ভেতর দিনে রাতে বিভিন্ন সময়ে ওনাদেরকে “খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো” টাইপের কবিতা শুনিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হল। তারপর ৩০ ডেসিবেল থেকে ১০০ ডেসিবেল পর্যন্ত আর্টিফিসিয়েল রাস্তার শব্দ বাজিয়ে দেয়া হল। কার কত ডেসিবেলে ঘুম ভাঙল তা রেকর্ড করা হলো।

সরকার এই ফলাফলের ভিত্তিতে নতুন রাস্তা আওয়াজ আইন জারি করলেন।
কোন বাড়িতে যদি রাস্তার আওয়াজের কারণে দুপুরে ৭৫ ডেসিবেল আর রাতে ৬৫ ডেসিবেল এর বেশি আওয়াজ পাওয়া যায়, তাহলে তারা ভর্তুকির জন্য আবেদন করতে পারবেন। এর নাম রাস্তার আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গা ভর্তুকি।

সরকারের নির্দেশে আওয়াজ মাপা শুরু হলো। নাগরিকদের জন্য একটা হটলাইন চালু করা হলো।
০১২০-১০৬-৪৯৭
জাপানে ফোন নাম্বার মনে রাখানোর জন্য একটা কৌশল ব্যবহার করেন। ০১২০ হল একটা প্রে-ফিক্স। এটা থাকা মানে এই ফোন ফ্রি।

১০৬-৪৯৭ এর জাপানি উচ্চারণ হচ্ছে (দো-রো য়কু নারে)। মানে হচ্ছে “রাস্তা তুই ভাল হয়ে যা”।
লোকজন এই নাম্বারে ফোন করলেন, ভর্তুকির জন্য প্রস্তুতি নিলেন জাপানের হাইওয়ে অপারেটর NEXCO কোম্পানি। ৮৫০০ কিমি রাস্তার মালিক তারা। ভর্তুকির টাকা গুনতে মাথায় হাত দিলেন।

আইন পরিবর্তন করার জন্য রাস্তার মালিক রাস্তায় নামলেন না। আইন পরিবর্তনের জন্য সরকারকে ঘুষ দিতে গেলেন না। আশ্রয় নিলেন প্রযুক্তির। বুদ্ধিজীবীদের ডাকলেন। আওয়াজ আর জ্বালা কমানোর জন্য প্রযুক্তিগত বুদ্ধি চাইলেন। দুটো প্রযুক্তি কাজে লাগানো হলো –

(১) ইঞ্জিনের সমস্যা না থাকলে আওয়াজ তৈরি হয় টায়ার আর রাস্তার ঘর্ষণ থেকে। নতুন এলিমেন্ট দিয়ে রাস্তা কারপেটিং করা হলো। গাড়ি কোম্পানি গুলোকেও ডেকে বসালেন, কম আওয়াজের টায়ার আর গাড়ীর নয়েজ রিডাকশানের জন্য। টয়োটা প্রিউস এর আওয়াজ কত জানেন? মাত্র ১১dB। গাছ থেকে শুকনা পাতা পড়ার আওয়াজ এর সমান।

(২) রাস্তার দুধারে সাউন্ড প্রুফ বেড়া (ফেন্স) বসানো হল। মিউজিক হল গুলোতে দেখবেন একরকম ছিদ্র ওয়ালা দেয়াল থাকে। এগুলো নয়েজ শুষে নেয়। ব্যয় বহুল। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গা ভর্তুকির চেয়ে সস্তা।

কিন্তু তাতেও সবাই সুখে শান্তিতে বাস করতে পারলেন না।
অন্য কাহিনি শুরু হলো। যারা গাড়ী চালান, এবার নালিশ আসলো তাদের পক্ষ থেকে। জাপানের হাইওয়ে আমেরিকার মত ফ্রি না। একটা প্রাইভেট কারের জন্য প্রতি কিমি ২৫ টাকার মত। তার মানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে আপনাকে টোল দিতে হবে ৬২৫০ টাকা।

গাড়ী ওয়ালারা নালিশ করলেন। আমরা এতো টাকা টোল দিয়ে হাইওয়েতে যাবো আর চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখবোনা? মোরা কি টাহা দিয়া জেল খানা দেখতে আইছি?

একেই বলে শাঁখের করাত, উভয় সঙ্কটে পড়া। বেড়া রাখলেও দোষ, না রাখলেও দোষ।

রাস্তার মালিকরা আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি চাইলেন। অনেক সাধনার পর বেরুলো সাউন্ড প্রুফ স্বচ্ছ দেয়াল। কাঁচের মত কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি। সৌন্দর্যও দেখতে পাবেন, শব্দ দূষণও ঠেকাবে। জাপানের যারা হাইওয়ে তে চড়বেন, আবাসিক এরিয়া গুলোর পাশের হাইওয়ে গুলোতে দেখবেন সাদা স্বচ্ছ একধরনের দেয়াল। প্রযুক্তির জয় এখানেই। প্রযুক্তির জন্য পলিসি নয়, পলিসি ঠিক রেখে প্রযুক্তি উদ্ভাবন।

ঢাকায় আমাদের এক পাশের বিল্ডিং এ কারো গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান হচ্ছে।রাত এগারোটা বাজে। ১০০ dB লেভেলে হিন্দি গান বাজছে। আরেক পাশে নতুন ফ্ল্যাট উঠছে। পাশের বাসায় সদ্যজাত শিশুটি ঘুমাতে পারছে না। বাপজান শিশুটিকে নিয়ে পায়চারি করছে। আগামী কাল সকালে তাঁর অফিস। ঘুম তাঁরও দরকার।
উন্নতির সাক্ষী নতুন বিল্ডিং উঠছে। ছাদ ঢালাই এর জন্য মসল্লা তৈরি হচ্ছে গরগরকরকর আওয়াজ হচ্ছে। এটাও ১০০ dB র কম না। আবারো বলছি রাত ১১ টা বাজে।

ঢাকা শহরে গড়ে শব্দ দূষণের পরিমাণ ৯০ dB এর কাছাকাছি। এর বেশিটাই আসে গাড়ীর হর্ন থেকে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অকারণে মাথা ধরা, হার্ট এর অসুখের কারণ। আর শব্দদূষণ ১০০dB মানে আপনার শিশুর কানে সমস্যার সৃষ্টি করবে।

দশ বছর আগে ঢাকায় একবার একটা পরীক্ষা করেছিলাম। বিনা হর্ণে কতক্ষণ গাড়ী চালানো যায়। এলিফ্যান্ট রোড থেকে কমলাপুর। কমলাপুর থেকে বড় মগবাজার। নো হর্ণ। ঢাকা শহরে বিনা হর্ণে গাড়ী চালানো সম্ভব। একটু ধৈর্য ধরতে হবে, এই যা।

ঢাকায় একটা “নো হর্ণ” দিবস চালু করা যায় না? এক ঝাঁক তরুণ করুক না গবেষণা। “নো হর্ণ” দিবসে কতটুকু শব্দ-দূষণ কমলো, কতটুকু স্বাস্থ্য রক্ষা হলো হোক না এটার পরিমাপ।

“নো হর্ণ” প্রথম থেকে কঠিন হতে পারে। অপ্রয়োজনীয় হর্ণ কমানোটা হলো উদ্দেশ্য। শুরু হতে পারে “পাঁচ হর্ণ” কর্মসুচি। একজন ড্রাইভারের জন্য হর্ণের বাজেট হোক দিনপ্রতি ৫টি, তারপর মাসে ৫টি , তারপর বছরে ৫টি। এভাবে শূন্যের কোঠায় পৌঁছতে কি বেশিদিন লাগবে?

আমাদের বাপ চাচারা যে ঢাকা শহর আমাদের দিয়ে গেছেন তার ভুক্তভোগী আমরা। আমরা যা করছি তার ভুক্তভোগী হবে আমাদের বাচ্চারা। কী ধরণের ঢাকা শহর শিশুদের কে উপহার দিতে চাই- নির্ভর করছে আমাদের ওপর।
জনগণের একটু সচেতনতাই ঢাকা শহর হতে পারে শিশুদের জন্য আরেকটু বসবাস উপযোগী।

Exit mobile version