* বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৬২/৭
* আফগানিস্তান: ৪৭ ওভারে ২০০/১০
* ফল: বাংলাদেশ ৬২ রানে জয়ী
* এই জয়ে টিকে থাকল বাংলাদেশের সেমিফাইনাল আশা। ৭ ম্যাচে ৭ পয়েন্ট বাংলাদেশের
ম্যাচটা টেস্ট, নাকি ওয়ানডে! আফগানিস্তান ইনিংসের তখন ৩১তম ওভার। উইকেটের পেছনে স্লিপে দাঁড়ানো একজন। উইকেটের পেছনে না হোক, সামনের দিকে তাকিয়ে যে একটু স্বস্তি খুঁজবেন ব্যাটসম্যান, সে উপায়টুকুও নেই। সিলি পয়েন্টেও যে ওত পেতে আছেন আরেকজন!
ইনিংসের অর্ধেক পার হয়ে যাওয়ার পর এমন দৃশ্য দেখতে পাওয়াটা একটু বিরলই বটে। বিশ্বকাপের ‘মহা গুরুত্বপূর্ণ’ ম্যাচে তো অভাবিত! আজ সাকিব আল হাসানের সৌজন্যে সেটিও দেখা হয়ে গেল। ওয়ানডেতে এমন ফিল্ডিং প্রতিপক্ষের ‘ছোটত্ব’কে চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেওয়া। ফুটবলে নাটমেগড হওয়ার মতোই সমান লজ্জার। আজ আফগানদের সেই লজ্জাই দিতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। এই ম্যাচের আগে আফগান অধিনায়ক গুলবদিন নাইব যে ‘বাংলাদেশকে হালকাভাবে নিচ্ছি না’—এমন গা জ্বলুনি কথা শুনিয়েছিলেন। এও বলেছিলেন, আমরা তো ডুবছিই, বাংলাদেশকে নিয়েই ডুবব। বাংলাদেশ ‘হালকা’ নয়, আফগানরা ভালো করেই বুঝল। সেই ভারে নিজেরাই ডুবে গেল আরও অতলে।
আর বাংলাদেশের সেমিফাইনাল আশা এখনো রইল জেগে। গুলবদিনের কথাগুলো স্রেফ গুলতাপ্পি প্রমাণ হয়ে গেল। এখন ওই বদন তিনি কোথায় লুকোবেন! অহমে চোট লাগলে সাকিব আল হাসান কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন, সেটিই যেন আজ নতুন করে টের পেল আফগানিস্তান। ব্যাটে বলে আজ সমান উজ্জ্বল সাকিব। নাহ্, বোলিংয়েই ঔজ্জ্বল্য ছড়ালেন বেশি। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে ৫ উইকেট নিলেন। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে মোট ১ হাজার রান পূর্ণ হলো। আর এবারের আসরে আবারও ফিরলেন শীর্ষ রানের মালিকের তালিকায়। বিশ্বকাপ ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে একই ম্যাচে ৫০ রান ও ৫ উইকেটের ডাবল কীর্তিও হলো।
এক সাকিব থেকেই আফগানদের দূরত্ব কত দূর—সেটাই আজ বুঝিয়ে দিল বাংলাদেশ। সাকিব নিজে ম্যাচ শেষে মুশফিকের কথা বলেছেন। দলের বিপদের সময় নেমে প্রায় শেষ পর্যন্ত থেকে ৮৩ রানের ইনিংসটির কারণে তিনিও বাহবা পাবেন। মুশফিক শেষ পর্যন্ত ছিলেন বলেই বাংলাদেশ ৭ উইকেটে ২৬২ রান তুলতে পেরেছে। সাউদাম্পটনের এ মাঠে এই স্কোর আরও বড়। বাংলাদেশ সেটাই প্রমাণ করে দিল শেষ পর্যন্ত, আফগানদের ২০০ রানে অলআউট করে দিয়ে।
ব্যাট হাতে প্রতি ম্যাচে রান পেয়েছেন বলেই কি না, আজ বোলার সাকিবের মাহাত্ম্যই বড় হয়ে দেখা দিল। ১০ ওভার পার হয়ে গেছে, অথচ মাশরাফি তখনো স্পিনত্রয়ীর কাউকেই আক্রমণে আনেননি। আফগানিস্তানের স্কোরবোর্ডেও ততক্ষণে উঠে গেছে ৪৮ রান। অস্বস্তি তখন একটু একটু করে উঁকি দিতে শুরু করেছে। একাদশ ওভারে আক্রমণে এসে অস্বস্তির মেঘ প্রথম দূর করলেন সাকিবই। রহমত শাহকে মিড অনে তামিম ইকবালের ক্যাচ বানিয়ে জানান দিয়ে রাখলেন, বাংলাদেশ নয়, আজকের ম্যাচে ডুববে শুধু আফগানিস্তানই।
তবে সাকিব নিজের বোলার সত্তার সেরাটা দেখালেন ইনিংসের ২৯তম ও নিজের পঞ্চম ওভারে। মাত্র দুই উইকেট হারিয়েই ১০০ পার করে ফেলেছে আফগানিস্তান, বাংলাদেশের সমর্থকদের কপালে আবারও দুশ্চিন্তার ভাঁজ। শর্ট কভারে দুজন ফিল্ডার রেখে গুলবদিনের জন্য টোপ পাতলেন সাকিব, প্রথম বলেই পাতা ফাঁদে পা দিয়ে দিলেন আফগান অধিনায়ক। লিটন দাসকে সুযোগ করে দিলেন, তাঁর ‘অন্যায়’ আউটের প্রায় হুবহু রিপ্লে করে প্রতিশোধ নেওয়ার। লিটন নিলেন পরিষ্কার ক্যাচ, তৃতীয় আম্পায়ার-সফট সিগনাল কিছুই লাগল না।
সাকিবের ক্ষুধা তখনো মেটেনি। ওই ওভারে তিন বলে মধ্যে সাকিবের দ্বিতীয় আঘাত। আর্মবলটা বুঝতে পারলেন না মোহাম্মদ নবী। বোল্ড! এক ওভার বিরতি নিয়ে নিজের সপ্তম ওভারে আসগর আফগানকেও ডিপ মিড উইকেটে বানালেন সাব্বির রহমানের ক্যাচ। ৮ রানে তখন সাকিবের নামের পাশে ৪ উইকেট।
কিন্তু পঞ্চম উইকেটটা আর কিছুতেই মেলে না। বাংলাদেশেরও অপেক্ষা বাড়ায় আফগানদের অষ্টম উইকেট জুটি। মাত্র ৪৫ বলে ৫৬ রান তুলে দুর্বল চিত্তের সমর্থকদের মধ্যে উল্টো ভয়ের শিহরণ ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছিল শেনওয়ারি-নজিবুল্লাহ জুটি। নজিবুল্লাহকে নিজের পঞ্চম শিকার বানিয়ে সে ভয়ও দূর করেছেন সাকিব। আজ শুধু ৫ উইকেট পেয়েছেন বলে নয়, প্রতিটা উইকেটই একেকটা বাঁক বদলের সাক্ষী ছিল যেন।
বোলিংয়ের আগে ব্যাট হাতেও ধরে রেখেছেন বিশ্বকাপে নিজের দুর্দমনীয় গতি। ৫১ রানে মুজিব উর রেহমানের বলে ফেরার আগে পেয়েছেন টুর্নামেন্টে নিজের তৃতীয় ফিফটি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নয় রানের জন্য ফিফটিটা হাতছাড়া করলে এক বিশ্বকাপে টানা ৬ ইনিংসে ফিফটি করা একমাত্র ক্রিকেটারও হয়ে যেতে পারতেন। সেটি না হলেও আরেকটি অর্জন হয়েছে। ১০ ওভারে মাত্র ২৯ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট পাওয়া সাকিবের বোলিং ফিগার এখনো পর্যন্ত এ বিশ্বকাপে যেকোনো বোলারের মধ্যেই সেরা।
তবে বাংলাদেশকে ২৬২ রান অবদি পৌঁছে দিতে মুশফিক ও মোসাদ্দেকের ইনিংস দুটির অবদানও অনেক। মোসাদ্দেকের ২৪ বলে ৩৫ রানের ইনিংসটি জুগিয়েছে শেষ দিকের মোমেন্টাম।
৬২ রানের এই জয় বাংলাদেশের সেমিফাইনালের স্বপ্নের ক্যানভাসেও চড়াল আরেকটু রং। ৭ ম্যাচে ৭ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট তালিকায় অবস্থান এখন পাঁচে। এবার ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ। এরপরই বোঝা যাবে, শেষ চারের স্বপ্ন পূরণ হলো কি না।