বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওয়ানডেতে দুই দলের সর্বশেষ নয়বারের মুখোমুখিতে সাতবারই জিতেছে বাংলাদেশ। তবু কি বিশ্বকাপে পরের ম্যাচে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে নিজেদের নিশ্চিন্ত ফেবারিট মনে করতে পারছে মাশরাফির দল? কেন এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভাবাচ্ছে নতুন করে?
ছিল শুঁয়োপোকা হয়ে, গেছে প্রজাপতি! ওয়েস্ট ইন্ডিজের রূপবদলে সবাই অবাক। হারুপাট্টি ক্যারিবীয় দল, বিশ্বকাপের বাছাইপর্বই যারা পেরিয়েছে নাভিশ্বাস তুলে, বিশ্বকাপ শুরুর আগের দিনও যাদের ব্রায়ান লারা ছাড়া আর কেউ গোনায় ধরেছে বলে শোনা যায়নি, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজই এবার কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে সবার! বাংলাদেশের পরের ম্যাচটাই ওদের সঙ্গে। এমনিতেই বৃষ্টিতে একটা ‘হাতে ধরে রাখা জয়’ ফসকে গেছে। আর গোনায় ধরা জয়গুলোর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটাও আছে। কিন্তু অত সহজ কি হবে?
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে গা-গরমের ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশের কাছে ন্যূনতম পাত্তাও পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পরপর তিন ম্যাচে বাংলাদেশ ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিয়েছিল ক্যারিবীয়দের। দুই দলের সবশেষ নয়বারের মুখোমুখিতে সাতবারই জিতেছে বাংলাদেশ। ত্রিদেশীয় সিরিজের আগে হোম-অ্যাওয়ে দুবারের দেখায়ও সিরিজজয়ী মাশরাফির দলই। এই ম্যাচে নিরাপদ বাজি তো বাংলাদেশই হওয়া উচিত?
আসলে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে বিস্তর ফারাক। এখন তো অনেকের চোখে ক্যারিবীয়রা শেষ চারের দাবিদার। পাকিস্তানকে যেভাবে পেস আর বাউন্স দিয়ে নাকাল করে বিশ্বকাপ শুরু করেছে তারা, ক্যারিবীয়দের বিশ্বকাপ ফেবারিট বলার দুঃসাহসে লারা সঙ্গী হিসেবে এরপর শেন ওয়ার্নদেরও পেয়েছেন। ওয়ার্ন বলেছিলেন, ইংল্যান্ড, ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজও খেলবে সেমিফাইনাল! অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জেতা ম্যাচটা হেরেও বাহবা কুড়িয়েছে দলটির। তৃতীয় ম্যাচে তাদের সামনে কাঁপছিল প্রোটিয়ারাও, শেষে বৃষ্টি এসে কলজে ভিজিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার।
অনেকেরই প্রশ্ন, র্যাঙ্কিংয়ে নয়ে থাকা দলটির এ পরিবর্তনের রহস্য কী? ব্যাটে বিধ্বংসী, বলে ত্রাস-জাগানিয়া! বাংলাদেশের সমর্থকেরাও এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। পরের ম্যাচে নিজেদের দলকে নিরঙ্কুশ ফেবারিট বলার ঝুঁকিটা নেওয়া ঠিক হবে কি না, তা তো খতিয়ে দেখা দরকার।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ত্রিদেশীয় সিরিজের দলটির সঙ্গে বিশ্বকাপে ১৫ সদস্যের দলের পার্থক্যটা দৃশ্যমান। ত্রিদেশীয় সিরিজের দল থেকে শুধু ৮ জন সদস্য সুযোগ পেয়েছেন বিশ্বকাপের মূল দলে। বাকিরা আইপিএলে ব্যস্ত ছিলেন। এই তথ্যের মধ্যেই সিংহভাগ জবাব লুকিয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমস্যা হলো, তারা আসলে দল হিসেবে এককাট্টা নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামে যেহেতু কোনো দেশ নেই, জাতীয়তাবাদী আবেগও খেলোয়াড়দের মধ্যে কাজ করে না। ফলে জ্যামাইকার গেইল-রাসেলরা জাতীয় দলের চেয়ে টি-টোয়েন্টির খেপকেই বাড়তি গুরুত্ব দেন। বড় লিগগুলোয় তাঁদের কদরও বেশি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটার র্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে পড়ে থাকার বড় কারণও এই একটা দল হয়ে উঠতে না পারা। কিন্তু যখন দল হয়ে ওঠে? তাদের চেয়ে ভয়ংকর আর কে হতে পারে! যখন সবাই অভিন্ন একটা স্বপ্নে বুঁদ হয়ে যায়, তাদের রোখে সাধ্য কার?
বিশ্বকাপের দলটির আত্মবিশ্বাস ত্রিদেশীয় দলের চেয়ে অনেক বেশি। আর এই আত্মবিশ্বাস তারা পেয়েছে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সামষ্টিক অভিজ্ঞতা থেকে। অনভিজ্ঞতার কারণেই হোক বা দলের কিছু মূল খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতিতেই হোক, ম্যাচ জয়ের জন্য সবটা দেওয়ার মানসিকতা ত্রিদেশীয় সিরিজের দলটির ছিল না। ঠিক এ জায়গাটাতেই বিশ্বকাপের দলটি আগের দলটি থেকে এত আলাদা।
বিশ্বকাপে গেইল-রাসেলদের মানসিকতা কী হবে, তা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে তাদের চার শ রান করা দেখেই আঁচ করা গিয়েছিল। খুনে মেজাজের খেলা দিয়ে যেকোনো দলকে ধরাশায়ী করার যে শক্তি, তা বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে অন্য উচ্চতায় তুলেছে।
ওপেনিং থেকে শুরু করে দলের মিডল অর্ডার এবং বোলিংয়ের ধার, এককথায় পুরো দলের চেহারাটাই আমূল বদলে গেছে। ওপেনিংয়ে শাই হোপের সঙ্গে ত্রিদেশীয় সিরিজে অনভিজ্ঞ জন ক্যাম্পবেল এবং সুনিল আমব্রিস সঙ্গী ছিলেন, কিন্তু বিশ্বকাপে আছেন ‘ইউনিভার্স বস’ ক্রিস গেইল বা বিস্ফোরক ওপেনার এভিন লুইস। এভাবে মিডল অর্ডারেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে বিশ্বকাপের দলে। হেটমায়ার এবং পুরানদের অভিজ্ঞতা এবং দ্রুত রান তোলার সক্ষমতা ত্রিদেশীয় সিরিজে চেজ বা কার্টারদের মধ্যে পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
রাসেল-থমাসদের পেস আর বাউন্সের তোপ সামলাতে যেখানে পাকিস্তানি আর অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানদের হাপিত্যেশ অবস্থা, সেখানে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কিনা মাত্র ২৩ ওভারে উইন্ডিজ বোলারদের তুলোধুনো করে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল জয় করেছিলেন ২১৩ রান করে! ত্রিদেশীয় সিরিজের দলটির তুলনায় বোলিংয়ের ধারও অনেক বেশি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপের দলটির।
ত্রিদেশীয় সিরিজে ম্যাচ উইনারের সংকট প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে, কিন্তু সেই সমস্যার সমাধান তারা পেয়ে গেছে রাসেল-গেইলদের সুবাদে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিজয়ী পাকিস্তানকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়ে শুরু করা ক্যারিবিয়ানরা বিশ্বকাপে তাই দৃষ্টিটা উঁচুতেই রাখছে।
মাঠে গেইল-রাসেলদের আক্রমণাত্মক খেলার সঙ্গে তাদের শরীরী ভঙ্গিও প্রতিপক্ষের অবস্থানকে নড়বড়ে করতে কার্যকর। প্রতিপক্ষকে তুলোধুনো করার মানসিকতা নিয়ে মাঠে নামা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টেক্কা দিতে হলে দরকার ইস্পাত-কঠিন মানসিকতা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের কোচ স্টিভ রোডসও সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেছেন, মূল ভয়টা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ডরহীন সত্তা নিয়েই।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে শেষ দুটি ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশ জিতলেও এ ম্যাচ নিয়ে মোটেও স্বস্তিতে থাকার উপায় নেই। কারণ বিশ্বকাপে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ অন্য রকম। ত্রিদেশীয় সিরিজের ‘সহজ’ দলটি তাই সোমবার টনটনে বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়াবে কঠিন প্রতিপক্ষ।