হাথুরু ২০১৭ সালের অক্টোবরে আকস্মিকভাবে বাংলাদেশ-পর্ব শেষ করে কোচ হয়ে চলে গেলেন নিজ দেশ শ্রীলঙ্কায়। এত আগ্রহ-আবেগ নিয়ে যে দলটার কোচ হলেন, সেখানে তিনি কি ভালো আছেন?
‘আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেল/ কত সুর, কত গান মনে পড়ে গেল/ বলো ভালো আছ তো?’—কাল ব্রিস্টল কাউন্টি ক্রিকেট মাঠে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে যখন বাংলাদেশ দলের দেখা হলো, ব্যাকগ্রাউন্ডে গানটা চালিয়ে দিলে দারুণ হতো! হাথুরুকে দেখলে আসলেই তো ‘কত সুর, কত গান’ মনে পড়ে যায় মাশরাফিদের! হয়তো তাঁদের এ প্রশ্নও জাগে, ‘ভালো আছেন তো?’
ব্রিস্টলের ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে যখন হাথুরু নেটের দিকে যাবেন, তখন এই প্রশ্নটাই করা হলো—শ্রীলঙ্কায় ভালো আছেন তো? দার্শনিক এক উত্তর মিলল তাঁর কাছে, ‘…চাইলে সবখানেই ভালো থাকা যায়।’ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে তাঁর চুক্তি ছিল ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। ২০১৭ সালের অক্টোবরে আকস্মিকভাবে বাংলাদেশ-পর্ব শেষ করে কোচ হয়ে চলে গেলেন নিজ দেশ শ্রীলঙ্কায়। চুক্তির শর্তর মেনেই তিনি বাংলাদেশ-অধ্যায় শেষ করেছেন। তবে তিনি যেভাবে চলে গেছেন, এটি নিয়েই যত আলোচনা-সমালোচনা।
হাথুরু অবশ্য বারবার বলেছেন, নিজের দেশের কোচ হওয়ার চেয়ে গৌরবের কিছু নেই! এ স্বপ্নই তিনি দেখেছেন। সেই স্বপ্নপূরণের সুযোগটা যখন এসেছে, সেটি আর হাতছাড়া করতে চাননি। এত আগ্রহ-আবেগ নিয়ে যে দলটার কোচ হলেন, সেখানে তিনি কেমন আছেন? মাঠে, মাঠের বাইরে নানা বিতর্কে হাথুরুর স্বস্তিতে থাকার কথা নয়। গত বছর জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বল টেম্পারিং নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি, যে ঘটনায় আইসিসি বড় শাস্তি দিয়েছে তাঁকে। গত দুই বছরে শ্রীলঙ্কান সংবাদমাধ্যমে বারবার খবর এসেছে, খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের অনেকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো নয়। গত এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার ভরাডুবির পর অধিনায়কত্ব হারানো অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস কোচ হাথুরুকে ইঙ্গিত করে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটকে (এসএলসি) চিঠি লেখেন, আমাকে ‘বলির পাঠা’ বানানো হয়েছে!
গত ফেব্রুয়ারিতে হাথুরুকে নির্বাচক কমিটি থেকেই ছেঁটে ফেলেছে এসএলসি। মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের আগে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কা দলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন তিনি। যেমন: দিনেশ চান্ডিমালকে বাদ দেওয়া, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যাঁকে কেন্দ্রে রেখে হাথুরু পরিকল্পনা করেন। লাসিথ মালিঙ্গাকে যেভাবে আকস্মিকভাবে ওয়ানডে অধিনায়ক করা হয়, এটা নিয়ে হাথুরু অসন্তুষ্ট ছিলেন। বোর্ড তাঁর এই অসন্তুষ্টিকে পাত্তাই দেয়নি। এই বিশ্বকাপে যাঁর নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কা খেলতে এসেছে, দিমুথ করুনারত্নে মাঝে ওয়ানডেই খেলেননি ৪ বছর! গত মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের প্রায় শেষ দিকে হঠাৎ দেশে ডেকে পাঠায় হাথুরুকে। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে ভারপ্রাপ্ত কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন স্টিভ রিক্সন। গত কয়েক মাসে শ্রীলঙ্কান সংবাদমাধ্যমে একাধিকবার খবর এসেছে, ২০২০ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগেই হাথুরু-পর্ব শেষ করে দিতে পারে এসএলসি।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ-অধ্যায় আকস্মিকভাবে শেষ করা হাথুরু শ্রীলঙ্কা দলের কোচ হিসেবে কাজ শুরু করেন ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। তাঁর শুরুটাও হয় দুর্দান্ত। বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে তিন সংস্করণের সিরিজেই হারায় শ্রীলঙ্কা। তবে এরপর খেই হারাতে থাকে লঙ্কানরা। হাথুরুর অধীনে ৫৩ আন্তর্জাতিক ম্যাচের ১৮টি জিততে পেরেছে শ্রীলঙ্কা। গত দেড় বছরে হাথুরুর সবচেয়ে বড় সাফল্য মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয়।
খুব সাধারণ এক কোচিং ক্যারিয়ার নিয়ে ২০১৪ সালের জুনে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন হাথুরু। তাঁর অধীনে বাংলাদেশ দ্রুত কিছু সাফল্য পেলে দ্রুতই তিনি হয়ে ওঠেন দলের সর্বক্ষমতার অধিকারী। যত দিন বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন, স্বাধীনভাবেই সব করেছেন। বাংলাদেশ দ্রুত সাফল্য পাচ্ছিল বলে বিসিবিও তাঁর সব চাহিদা পূরণ করেছে হাসিমুখে। তবে বিসিবির সঙ্গে যেটি অনায়াসে করতে পেরেছিলেন নিজ দেশের ক্রিকেট বোর্ড এসএলসির সঙ্গে সেটি আর করতে পারেননি হাথুরু। তাঁর অধীনে দলও পায়নি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। বোর্ড আর হাথুরুর সঙ্গে দূরত্ব তাই ক্রমেই বেড়েছে। এই বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কাকে ভালো ফল না এনে দিতে পারলে কে জানে, লঙ্কানদের হয়ে এটিই হয়ে যেতে পারে তাঁর শেষ টুর্নামেন্ট!
বাংলাদেশ ক্রিকেটে হাথুরু-প্রসঙ্গ এখন অতীত। লঙ্কান এই কোচকে নিয়ে আগের উত্তাপ, আলোচনা-সমালোচনা নেই দেশের ক্রিকেটে। মাঝে যে উত্তাপ ছড়িয়েছে হাথুরুর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলা হলে, সেটি কমে এসেছে অনেকটাই। মাথায় নীল হ্যাট, হাতে থ্রো ডাউনের সরঞ্জামাদি, মুখে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে কাল যখন দলের অনুশীলনে যাচ্ছেন; এক সংবাদমকর্মী হাথুরুকে প্রশ্ন করলেন, দুই দলকে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ দেখা যাচ্ছে। ম্যাচেও কি এটা থাকবে? ‘২২ গজে সেটি আর থাকবে বলে মনে হয় না!’—মাঠের বাইরে যত সৌজন্য বিনিময় হোক, তিনি সুখে-অসুখে যা–ই থাকুন, মাঠের লড়াইয়ে বাংলাদেশকে আবারও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন হাথুরু।