Site icon দ্বিপ্রহর ডট কম

অশান্তির কুরুক্ষেত্র উপমহাদেশ: প্রবীর বিকাশ সরকার

বিগত ৩৫ বছরে জাপানের তো কম পরিবর্তন দেখলাম না! এই একটি দেশ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমাগত বদলে চলেছে। গ্রহণ-বর্জন জাপানের শক্তিমত্তার বড় পরিচয়। কিন্তু বিগত ১৫০ বছর ধরে আধুনিক জাপান যেভাবে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসা, ধর্মীয়, শিক্ষা, সেবা, সংস্কৃতি, উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন সাধন করে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সেভাবে পারেনি ভারত। ভারতের সঙ্গে জাপানের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, জাপানের মূলমন্ত্র অর্থনীতি আর ভারতের মূলমন্ত্র ধর্ম। জাপানের রাজনীতিকে বিগত ১৫০ বছরের ইতিহাসে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে ন্যাশনালিস্ট ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিরা। আর বিগত ২০০ বছর ধরে ভারতবর্ষকে নিয়ন্ত্রিত করে এসেছে ধর্মবাদীরা। কিন্তু এই ধর্মবাদীরা ভারতে শান্তি আনতে পারেনি আজও। কিন্তু বিগত ১৫০ বছরে জাপানকে এগিয়ে নিয়েছে ব্যবসায়ীরা। জাপান আজ শান্তির দেশ।

এই জাপানেও প্রাচীনকাল থেকে মেইজি মহাপরিবর্তন (১৮৬৮-১৯১২) যুগের প্রথম দিক পর্যন্ত শিন্তোও এবং বৌদ্ধধর্ম সমানভাবে রাজনীতি তথা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত, নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত করেছে। শান্তি ছিল না, ক্রমাগত ক্ষমতার লড়াই, গৃহযুদ্ধ-দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগেই ছিল মধ্যযুগের শেষভাগ পর্যন্ত। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জাপানে প্রবেশ করতে লাগল পাশ্চাত্যের আধুনিক ধ্যানধারণা, শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-কারিগরি, সংস্কৃতি, দর্শন এবং মানবতার আলো জোরালোভাবে। পাশ্চাত্যে আধুনিকতার বিপ্লব তথা রেনেসাঁর উদ্গাতারা ছিলেন ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী কিন্তু তারা ছিলেন উদারমনস্ক, মানবতাবাদী এবং প্রগতিশীল। এই দুই ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন একাধিক জাপানি নাগরিক যারা মেইজি যুগে শিক্ষা বিপ্লব, শিল্পবিপ্লব এবং প্রাচ্যভাতৃবাদের জন্ম দিয়েছিলেন। তাদের ওপর প্রভাব ছিল গুপ্ত সংস্থা ফ্রিমেসনের। মেইজি মহাপরিবর্তনের পর মাত্র ২০ বছরের মধ্যে জাপান সর্বদিক দিয়ে পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ শক্তির সমকক্ষ হয়ে উঠেছিল। সেইসময়কার আধুনিক চিন্তাসম্পন্ন শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীরা একদিকে কট্টর জাতীয়তাবাদী অন্যদিকে আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তারা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন, ধর্ম কোনোদিন শান্তি আনবে না, ধর্মের জায়গায় ধর্ম থাকুক এক আনন্দ-উৎসবের প্রতিভূ হয়ে, কিন্তু রাজনীতিতে, বাণিজ্যে এবং শিক্ষায় যেন প্রভাব ফেলতে না পারে। তাই মেইজি যুগেই “সেইকিয়োও বুনরি” নামে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাজনীতি ও ধর্মকে আলাদা করে দিয়েছেন। ফলে রাজনীতি ও অর্থনীতি তথা ব্যবসার মধ্যে সমঝোতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু কীসের জন্য? দেশের জন্য, জনগণের জন্য—নিজেদের জন্য নয়।

কিন্তু ভারতে ধর্ম, রাজনীতি এবং অর্থনীতি পরস্পর এমনভাবে অবিচ্ছেদ্য যে, বিগত ২০০ বছরেও তাদেরকে আলাদা করা যায়নি। এমন এক জটিল সম্পর্ক সরকার ও জনগণের মধ্যে গভীর শিকড় গেড়ে আছে যে, এক পা এগোলে তিন পা পেছায়। যত বড় নেতা ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম নিয়েছেন সবাই ধর্মদ্বারা অন্ধভাবে প্রভাবিত হয়েছেন, নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন এবং মানবতাবাদ, শান্তি ও অগ্রগতি কোনোটাই প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। দূর করতে পারেননি দারিদ্র、ক্ষুধা আর বৈষম্য।

জাপান যেভাবে পাশ্চাত্য শক্তি, মেধা ও শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েছে পুরো মাত্রায়, ভারত একভাগও পারেনি। আর পারবে বলে মনেও হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত না ভারত নিজেকে বদলাতে সক্ষম হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত উপমহাদেশে শান্তি, সৌহার্দ এবং অগ্রগতি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবে।

স্বাধীনতার ৭০ বছর পরও ভারত আজ পর্যন্ত স্থির করতে পারল না তার গন্তব্য আসলে কোনটা?অদৃষ্টবাদ নাকি বাস্তববাদ?

Exit mobile version