কথায় বলে “নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নেই”। অর্থাৎ সব সময় সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা সবার জন্যই অনিশ্চিত এবং যে কোন সময় যে কোন ধরণের অসুস্থতা আমাদের যে কোন মানুষের জীবনকেই অসম্ভব ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে, এমনকি হঠাৎ কোন কারণে আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। জন্মগ্রহণ করলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। মৃত্যু অনিবার্য যাকে আমৃত্যু করা মানুষের পক্ষে এখনও সম্ভব হয়ে ওঠেনি কিন্তু সুস্থ জীবনের জন্য জীবনের উপরে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মানুষের আছে।
এমন অনেক অসুস্থতা আছে যেগুলো সম্পর্কে আমাদের যদি টুকি-টাকি জ্ঞান থাকে অথবা সে অসুস্থতাগুলো ব্যাবস্থাপনার ছোট-খাট বিষয়গুলি সম্পর্কে আমাদের একটু জানা থাকে তাহলে তা প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা অনেক সময়েই অনেকের মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে পারি। মৃত্যুটাই সব নয়, অনেক সময় এমন হয় যে, অসুস্থতার কারণে মৃত্যু হয়তো হলো না কিন্তু এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলো যে পরবর্র্তীতে সারা জীবন তার খারাপ পরিণতি বয়ে বেড়াতে হলো, যার থেকে মৃত্যুও হয়ত শ্রেয়। প্রতিনিয়তই এমন নানান ধরণের অসুস্থতার সম্মুখীন আমরা হচ্ছি। আমরা হয়তো জানিই না যে এমন অনেক ক্ষেত্র বা বিষয় আছে যে ক্ষেত্রে আমরা আমাদের সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমেই অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ করে তুলতে পারি, যদি আমরা একটু সচেতনভাবে এ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি এবং সে জ্ঞান যেখানে প্রয়োজন সেখানে প্রয়োগের চেষ্টা করি।
চিকিৎসকের অপ্রতুলতা প্রায় বিশ্বব্যাপি। চিকিৎসা সরঞ্জাম ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ততাও বিশ্বব্যাপি প্রশ্ন সাপেক্ষ। তাছাড়া এ সমস্তকিছুর পর্যাপ্ততা যতই থাকুক না কেন প্রতি ঘরে ঘরেতো আর চিকিৎসক রাখা সম্ভব নয়, আর চিকিৎসক থাকলেও তার পক্ষে পরিবারের সবাইকে সর্বক্ষণ সঙ্গ দেওয়াও সম্ভব নয়। যে যার কাজে ব্যস্ত থাকে, একজন ডাক্তার থাকলে তারও ব্যস্ততা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে অসুস্থ হবার কোন দিন-ক্ষণ নেই, যে কেউ যে কোন সময় যে কোন স্থানে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। এজন্যে হর হামেশাই আমাদের জীবনে ঘটে থাকে, এমন কিছু অসুস্থতার বিষয় সম্পর্কে আমাদের সবারই একটু-আধটু জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
অনেক সময় হঠাৎ করেই আমরা যে কেউ এমন ধরণের অসুস্থতায় আক্রান্ত হতে পারি যার জন্যে দু’ এক মিনিটের তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাই আমাদের সুস্থ হবার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। এ জন্যে ডাক্তার হবার প্রয়োজন নেই। আমরা নিজেরাই সে ধরণের ব্যবস্থাপনা দেবার জন্যে যথেষ্ট। আমরা জরুরি প্রয়োজনে তা দিয়েও থাকি কিন্তু এ সংক্রান্ত জ্ঞান পর্যাপ্ত না থাকার কারণে তা হয়তো যথেষ্ট হয় না। যে কারণে একদিকে যেমন অসুস্থ ব্যক্তিও ঠিকভাবে সুস্থ্ হয় না, অন্যদিকে যথেষ্ট সেবা দেবার পরেও সেবা প্রদানকারী সেবা প্রদানের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করতে পারে না। ঠিক করলাম, না বেঠিক করলাম এ ধরণের একটা আশঙ্কা সেবা প্রদানকারীকে আচ্ছন্ন করে। অথচ এ সমস্ত বিষয় সম্পর্কে একটু জানা থাকলে একদিকে যেমন অসুস্থ ব্যক্তিকে যথাযথ সেবা দিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলা যায় বা সুস্থ হবার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তার অসুস্থ হয়ে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমানো যায় অন্যদিকে সেবা প্রদানের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করা যায়। অসুস্থ ব্যক্তিকে যদি কোন কারণে সুস্থ করা নাও যায় সেক্ষেত্রে এ শান্তনাটুকু অন্তত পাওয়া যায় যে, প্রকৃত সেবাটা অন্ততঃ প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। এ শান্তনাটুকুই বা কম কিসে?
যে কোন কারণে মানুষের হঠাৎ কোন অসুস্থতায় তাকে সুস্থ্ রাখার জন্য, ডাক্তারের নিকট পৌঁছে ডাক্তারী চিকিৎসা প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত অসুস্থ মানুষটির জীবন বাঁচানোর জন্য তাকে প্রাথমিকভাবে যে সমস্ত জরুরি চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়, সে গুলোকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা বলে। এধরণের সেবা দিতে হলে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে দেওয়া উচিৎ; এ সকল সাদা-মাটা নিয়ম-কানুনগুলিকে বলে প্রাথমিক স্বাস্থ্ প্রতিবিধান।
যেমন: গাছ থেকে পড়ে হাড় ভাঙ্গা, পানিতে ডোবা, বিষ খাওয়া, অনেক্ষণ রোদে থেকে অসুস্থ্ হয়ে পড়া ইত্যাদির প্রাথমিক চিকিৎসা।
তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্ সেবা বা প্রাথমিক স্বাস্থ্ প্রতিবিধান এর গুরুত্বঃ
১. মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা কমানঃ অসুস্থ্ হলে অনেক সময় অনেকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে যা হয়তো অস্বাভাবিকও নয়। আবার এমনও হতে পারে যে, অসুস্থতার মাত্রা হয়তো তেমন বেশী কিছু নয় যে তা অসুস্থ ব্যক্তির জন্যে ঝুঁকির বড় কোন কারণ হতে পারে কিন্তু শুধুমাত্র মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার কারণেই তার ঝুঁকির মাত্রাটা বেড়ে যেতে পারে। এ সকল ক্ষেত্রে অসুস্থ ব্যক্তিকে যদি কেউ আস্বস্ত করতে সক্ষম হয় যে, এ অসুস্থতা তেমন কিছু নয়, এ বিষয় সম্পর্কে যিনি সেবা প্রদানকারী তার যথেষ্ট জ্ঞান আছে, তা হলে অসুস্থ ব্যক্তির দুশ্চিন্তার মাত্রা কমে গিয়ে তার মানসিক জোর বেড়ে যাবার সম্ভাবনা বেশী, যা তার সুস্থ হবার জন্যে সহায়ক। আবার যদি সেবা প্রদানকারীর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অসুস্থ ব্যক্তির পূর্ব থেকেই জানা থাকে তবে তা আরো সহায়ক হয়। এমনও হতে পারে যে, সেবা প্রদানকারী সম্পর্কে অসুস্থ ব্যক্তি পূর্ব থেকে কিছু জানেন না কিন্তু সেবা প্রদানের ধরণ দেখে তার প্রতি আস্থা চলে আসতে পারে যা তার সুস্থ হবার জন্যে সহায়ক।
২. মানসিক অসস্থি কমান:অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করার জন্যে অনেক সময় এমন কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় যা একজন সাধারণ মানুষ অর্থাৎ যিনি এ সম্পর্কে কম জানেন অথবা জানেন না, তেমন মানুষ সে কাজগুলি করতে গেলে অসুস্থ মানুষটি অসস্তি বোধ করতে পারেণ। কিন্তু যে ব্যক্তি এ সম্পর্কে জানেন তার নির্দেশনা পালন করতে অসুস্থ মানুষটি অপেক্ষাকৃত বেশী মানসিক স্বস্থি বোধ করবেন যা তার সুস্থ হবার জন্যে সহায়ক। এ কারণে তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্ সেবাদানকারী বা প্রাথমিক স্বাস্থ্ প্রতিবিধানকারী অসুস্থ মানুষের কাছে গিয়ে তাকে প্রথমেই নিজের অভিজ্ঞতার বিষয়ে তাকে আস্বস্ত করবেন।
৩. রোগীর মানসিক সাহস বাড়ানঃহঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে যে সমস্ত ক্ষেত্রে অসুস্থ মানুষের মানসিক সাহস হ্রাস পায় এবং মানসিক চাপ বেড়ে যায়, সে সমস্ত ক্ষেত্রে তার মানসিক সাহস বাড়ানোর কাজটি সুস্থ্ হবার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া একজন মানুষ যদি তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জ্ঞান আছে এমন একজনকে কাছে পায় তাহলে ঐ অসুস্থ ব্যক্তির মানসিক সাহস আপনা আপনিই বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক এবং এটা জরুরিও বটে।
৪. কেটে যাওয়ার ক্ষেত্রে রক্ত পড়া কমানঃ তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্য সেবা বা প্রাথমিক স্বাস্থ্য প্রতিবিধানে যে কয়েকটি বিষয়ের দিকে খুব বেশী গৃরুত্ব দিতে হয়, রক্তপাত থাকলে রক্ত পড়া বন্ধ করা এবং বন্ধ করা সম্ভব না হলে যথাসম্ভব রক্তপাত কমানো তার মধ্যে অন্যতম। (রক্ত পড়ার ধরণ এবং তার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।)
৫. হৃতপিন্ডের গতি বেশী হয়ে গেলে, গতি নিয়ন্ত্রণে আনাঃ তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্য সেবা বা প্রাথমিক স্বাস্থ্য প্রতিবিধানের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হৃতপিন্ডের গতি বেশী হয়ে গেলে, গতি নিয়ন্ত্রণে আনা। বেশী রক্তপাতের কারণে শক হয়ে যেমন তাৎক্ষণিক মৃত্যু হতে পারে তেমনি হৃতপিন্ডের গতি বেশী থাকলে হার্টফেল করে তাৎক্ষণিক মৃত্যুও হতে পারে।
৬. অজ্ঞান রোগীর ক্ষেত্রে তার শারীরিক অবস্থার প্রাথমিক ধারণা পাওয়া: অজ্ঞান রোগীর ক্ষেত্রে যেহেতু অসুস্থ্ ব্যক্তি কথা বলতে পারে না সেহেতু স্বাস্থ্য সেবাদানকারীকে অসুস্থতার কারণ বের করার জন্যে বেশী সতর্ক ও কৌশুলী হতে হয়। যদি কোন প্রত্যক্ষদর্শী থাকে তবে তিনি হতে পারেণ এ সংক্রান্ত তথ্য প্রদানকারী। যদি কোন প্রত্যক্ষদর্শী না থাকে সে ক্ষেত্রে লক্ষণ ও উপসর্গগুলিই হতে পারে তথ্য জানার প্রধান উৎস। জীবনের প্রধান লক্ষণগুলো যেমন, বুক ওঠা-নামার মাধ্যমে শ্বাসপ্রশ্বাসের অবস্থা জানা, শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে নাড়ীর গতি পরীক্ষা করা, হৃতপিন্ডের শব্দ কেমন তা জানার মাধ্যমে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৭. হাড় ভাঙ্গা রোগীর ক্ষেত্রে ভাঙ্গা স্থানের নড়াচড়া বন্ধ রাখাঃ হাড় ভেঙ্গে গেলে যদি ভাঙ্গাস্থান নড়াচড়া করানো হয় তাহলে রোগীর বিপদ আরো বেড়ে যেতে পারে। ভাঙ্গা অংশ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে অথবা নড়াচড়ার কারণে রক্তপাত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভাঙ্গা স্থানের নড়াচড়া বন্ধ রাখার দিকে তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী বা প্রাথমিক স্বাস্থ্য প্রতিবিধানকারীকে লক্ষ্য রাখতে হবে।(যুক্তিযুক্তের লিখিত এবং অন্বেষা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘হঠাৎ অসুস্থতায় জরুরি চিকিৎসা’ গ্রন্থ থেকে সঙ্কলিত)