বিষাক্ত কোন কঠিন, তরল বা বায়বীয় বস্তু শরীরের সংস্পর্শে আসলে, খেয়ে ফেললে বা পান করলে তা শরীরের ক্ষতি করতে পারে, মানুষ অসুস্থ্য হয়ে পড়তে পারে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ ধরণের ঘটনাকে বিষক্রিয়া বা পয়জনিং বলে।
বিষক্রিয়ার দু’ধরণের ইফেক্ট হতে পারে। –
ক. লোকাল: আক্রান্ত হলে শরীরের যে স্থানে পয়জন লাগে শরীরের সে স্থানের ক্ষতি হয়, সারা শরীরে বা দেহে ক্ষতিকর প্রভাব তেমন পড়ে না। যেমন – ত্বকে এসিড লাগা।
খ. সিষ্টেমিক: আক্রান্ত হলে সারা দেহ বা শরীরের ক্ষতি হয় বা হতে পারে। যেমন – কোন পয়জন পান করা, ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে ঢোকান।
পয়জনের ক্ষতিকর প্রভাব নির্ভর করে –
ক. পয়জনের পরিমানের উপর: বেশী পয়জনের সংস্পর্শে আসলে, খেয়ে ফেললে বা পান করলে তা শরীরের জন্যে বেশী ক্ষতির কারণ হবে।
খ. পয়জনের ধরণের উপর: পয়জনের ক্ষতিকর বৈশিষ্ট বেশী হলে অর্থাৎ বেশী শক্তিশালী পয়জন হলে এবং তা শরীরের সংস্পর্শে আসলে, খেয়ে ফেললে বা পান করলে শরীরের জন্যে বেশী ক্ষতির কারণ হবে।
গ. শরীরে প্রবেশের পথের উপর: পয়জন মুখে পান করেছে না কি ইনজেকশন নিয়েছে অথবা ত্বকে লেগেছে ইত্যাদি বিষয়ের উপরও এর ক্ষতিকর প্রভাব নির্ভর করে।
ঘ. শরীরের গঠনের উপর: স্বাস্থ্যবান হলে ক্ষতির সম্ভাবনা একটু কম, দূর্বল হলে ক্ষতির সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশী।
বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার মূলনীতি-
ক. পয়জনের যে অংশ তখনও বাইরে অবশিষ্ট আছে তাকে দূরে সরিয়ে ফেলা নইলে তাড়াহুড়োর মধ্যে নতুন করে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। যদি কেউ সুইসাইড করার জন্যে ইচ্ছাকৃতভাবে বিষ পান করে তবে অবশিষ্ট অংশও পান করার চেষ্টা করতে পারে।
খ. শরীরে যে পয়জন ঢুকে গেছে এনটিডোট দিয়ে বা পয়জনকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে এমন কিছু প্রয়োগ করে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তা নিস্ক্রিয় করার ব্যাবস্থা করা।
গ. পয়জনের যে অংশ তখনও শরীরে শোষণ হয়নি তাকে শোষিত হতে বাঁধা দেওয়ার ব্যাবস্থা গ্রহন করা।
ঘ. বিষ ক্রিয়ার সাধারণ লক্ষণ অনুযায়ি চিকিৎসা দেওয়া। যেমন – শরীরের রক্তচাপ, নাড়ীর গতি, শ্বাস প্রশ্বাস, তাপমাত্রা ইত্যাদি ঠিক রাখার ব্যাবস্থা করা।
ঙ. যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে পাঠানো।
বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখতে করণীয়-
১. পা উচুঁ করে শুইয়ে রাখা যাতে মস্তিস্কে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে।
২. বিষক্রিয়ার ফলে যদি শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ বাঁধাগ্রস্থ হয়ে শরীরের তাপমাত্রা কমে যায় তাহলে কম্বল বা অন্য গরম পোষাক দিয়ে শরীর ঢেকে রাখা যাতে শরীর গরম হয়।
৩. রক্তচাপ খুব কমে গেলে শরীরে প্রচুর ফ্লুইড দেওয়া । যদি রোগী ঢোক গিলতে পারে বা এমন অবস্থায় থাকে যে ঢোক গিললে তার ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, সেক্ষেত্রে পানি পান করান। যদি পান করান সম্ভব না হয় তাহলে অভিজ্ঞতা আছে এমন কারো দ্বারা শিরায় স্যালাইন দেওয়া। যদিও স্যালাইন দেওয়ার পদ্ধতি ও নিয়ম-কানুন জানা না থাকলে উপযুক্ত পরিবেশ ছাড়া স্যালাইন না দেওয়াই ভাল।
৪. হৃতপিন্ডের স্পন্দন ঠিক রাখার জন্যে প্রয়োজনে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দেওয়া।
বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক রাখতে করণীয়-
১. শ্বাসনালী পরিষ্কার করে রাখা যেন সহজে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে। লালা জমে বা অন্য কোন ভাবে যেন শ্বাসনালী পুনরায় বন্ধ না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখা। যদি বার বার বন্ধ হতে থাকে তবে প্রতিবারেই তা পরিষ্কার করা।
২. প্রয়োজন হলে মাউথ-গ্যাগ ব্যাবহার করা। দুই পাটি দাঁতের মাঝখানে এমন শক্ত কোন কিছু ব্যাবহার করা যেন দাঁত লেগে শ্বাস-প্রশ্বাস বাঁধাগ্রস’ না হয়। এমন শক্ত কোন কিছুকে মাউথ-গ্যাগ বলে। লোহা বা অতো শক্ত কোন কিছু ব্যাবহার না করা ভাল এতে দাঁত ভেঙ্গে যেতে পারে। অসুস্থতার কারণে অনেক সময়ে দাঁতের মাঝে পড়ে জিহ্বা কেঁটে যেতে পারে, আবার হা করিয়ে মুখ গহব্বর পরিষ্কার করার সময়ে সাহয্যকারীর হাতেও কামড় লাগতে পারে, মাউথ-গ্যাগ সেটি থেকে রক্ষা করে।
৩. সম্ভব হলে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস চালানো। মুখ থেকে নাকে বা মুখ থেকে মুখে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস চালানো।
পয়জন খাওয়ার পর বমি করানোর সাধারণ উপায়-
১. যদি পান করানোরমত অবস্থা থাকে তবে প্রচুর কুসুম গরম পানি পান করান।
২. আধা লিটার পানিতে এক টেবিল-চামচ সরিষার তেল বা দুই চামচ খাবার লবন মিশিয়ে পান করান। অনেক সময়ে পানিরসাথে গু-গবর মিশ্রিত করে পান করানো হয়, এটি ঠিক নয়।
৩. জিহ্বার পিছনের দিকে গলায় সতর্ক ভাবে শুড়শুড়ি দিয়ে বমি করাণো। এটিই আদর্শ পদ্ধতি। তবে যদি শুড়শুড়ি দিতে গেলে রোগীর অন্য কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে তাহলে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে এ্যসিড জাতীয় কোন খিছু পান করলে এটি করান যাবে না।
কখন বমি করানোর চেষ্টা করা উচিৎ নয়-
১. যদি রোগী বাচ্চা হয় তাহলে।
২. যদি রোগী অজ্ঞান থাকে। অজ্ঞান রোগীর ক্ষেত্রে তরল বমি খাদ্যনালী থেকে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে রোগীর আরো বেশী ক্ষতি করতে পারে।
৩. যদি রোগীর খিঁচুনী থাকে। খিঁচুনী রোগীর ক্ষেত্রেও অজ্ঞান রোগীরমত তরল বমি খাদ্যনালী থেকে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে রোগীর আরো বেশী ক্ষতি করতে পারে।
৪. যদি রোগী এসিড বা এ্যালকালী (করোসিভ পয়জন) খেয়ে/পান করে থাকে। এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত নরম স্থান ছিড়ে বা ফুটো হয়ে যেতে পারে।
৫. যদি রোগীর শরীরের তাপমাত্রা খুব কম থাকে। তাহলে বমি করানোর চেষ্টা করলে তাপমাত্রা আরো কমে যেতে পারে।
৬. যদি রোগী কেরোসিন পান করে থাকে। কেরোসিন উদায়ী হয়ে ফুসফুসে যাওয়ার ভয় থাকে এ কারণে।
৭. যদি রোগী গর্ববতী হয়। বমি করতে গেলে তলপেটে অতিরিক্ত চাপ লেগে পেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
৮. যদি রোগীর হার্ট ডিজিজ থাকে। বমি করার ঝাঁকুনী সহ্য করার ক্ষমতা নাও থাকতে পারে সে জন্যে।
(যুক্তিযুক্তের লিখিত এবং অন্বেষা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘হঠাৎ অসুস্থতায় জরুরি চিকিৎসা’ গ্রন্থ থেকে সঙ্কলিত)