প্রবীর বিকাশ সরকার: আমার জীবদ্দশায় দুটি যুদ্ধের কথা মনে আছে। ১৯৬৫ সালের প্রথম পাক-ভারত যুদ্ধ। তখন আমার বয়স ৭। শুধু মনে আছে রাতের বেলা ঘরের বাইরে আলো নেয়া যেত না। সন্ধের পর কুমিল্লা শহর অন্ধকারে ভুতুড়ে-ভুতুড়ে দেখাত।
কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ অভিজ্ঞতা আছে। আমরা ভারতে পালিয়ে যাইনি। কুমিল্লা শহরেই ছিলাম ন’টি মাস লুকিয়ে। পাক বাহিনীকে দেখেছি, টা টা করে গুলি ছুঁড়তে দেখেছি, ট্রাক ভরে তরুণদের ধরে নিয়ে যেতে দেখেছি, কালো পোশাকের মিলিশিয়া বাহিনী ও রাজাকার দেখেছি। গোলাগুলি, বোমা বিস্ফোরণ, গ্রেনেড ফাটার শব্দ সারাদিনরাত ধরে শুনতাম। কুমিল্লা স্বাধীন হয় ৮ই ডিসেম্বর, বিজয়ের প্রথম সকালটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তখন আমি ১২।
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি তাই একটা রোমান্টিজম তারুণ্যে জন্মলাভ করেছে। জাপানে আসার পর গ্রন্থাগারে এশিয়ার একাধিক স্বাধীনতা সংগ্রাম ও যুদ্ধ নিয়ে লিখিত ফিচার, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ পাঠ করার সুযোগ হয়েছে পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনে। পরবর্তীকালে একাধিক বইও পাঠ করেছি। সবই জাপানি ভাষায়। চলচ্চিত্র, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ হয়েছে। রোমান্টিকতা কেবল গাঢ়ই হয়েছে।
সেইসব পড়ে জেনে অবাক হয়েছি যে অধিকাংশ দেশ যেমন চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, বার্মা, ইন্ডিয়া এবং কোরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে জাপান জড়িত। বিংশ শতাব্দীতে জাপান তখন ইম্পেরিয়াল জাপান। কোরিয়া, চীনের মাঞ্চুলিয়া, তাইওয়ান তার দখলে। আর বাকী দেশগুলো মুক্তিকামী। ফ্রান্স, ন্যাদারল্যান্ডস, স্পেইন-আমেরিকা, ব্রিটেনের শাসন থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করছে। এইসব দেশের স্বাধীনতার নেতা ও কর্মীরা জাপানের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রত্যাশী।একাধিক নেতা জাপানে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। জাপানে থেকে জাপানি ন্যাশনালিস্টদের সাহায্যে লড়াই করে চলেছেন।
১৮৯৫ সালে চীনের প্রচণ্ড শক্তিশালী শাসক কুইং বংশকে এবং ১৯০৫ সালে পরাক্রমশালী রুশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে পরাজিত করে বিশ্বে তাক্ লাগিয়ে দিয়েছে ক্ষুদ্র এক শংকরজাতি জাপান। পরাধীন এশিয়ার দেশগুলোকে অপরিসীম আন্দোলিত, আলোড়িত ও উৎসাহিত করেছিল জাপানের এই বিজয়। আশান্বিত করে তুলেছিল শতাধিক বছরের বিদেশি শক্তির পরাধীন দেশগুলোর নেতৃবৃন্দকে। যেমন চীনের ড.সান ইয়াৎ-সেন, ভিয়েতনামের ফান হোইচোও, বার্মার বা মো, ফিলিপিন্সের হোসে রিসাল, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণো, ভারতের বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, কোরিয়ার কিম অক্কিউন প্রমুখ। তাদেরকে সহযোগিতা দিয়েছেন সুদীর্ঘ বছর তথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত জাপানি ‘দাই আজিয়া শুগি’ বা ‘প্যান-এশিয়ানিস্ট’ রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান জড়িয়ে গেলে এক টানে ভারতকে বাদ দিয়ে পুরো এশিয়া জাপানের করতলগত হয়। টানা চার বছর যুদ্ধ চলে এশিয়াব্যাপী। সে কী রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ! মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে একাধিক চলচ্চিত্র ও ভিডিও দেখে আমার তাই ধারণা হয়েছিল। আমার এক জাপানি বন্ধু তাকারাদা তোকিও স্যারের ব্যক্তিগত সংগ্রহকক্ষে অনেকগুলো চলচ্চিত্র ও ভিডিও তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন ২০০০ থেকে ২০১১ পর্যন্ত। বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার মতো! এও দেখেছি, তিনিও বলেছেন, যুদ্ধে জাপান হেরে গেলেও যুদ্ধের পর পর সবগুলো দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে বিতাড়িত করেছে জাপান।
কিন্তু এই যে লাগাতার সংগ্রাম, যুদ্ধ চলেছিল বিংশ শতকে এশিয়ায় তার উপর খুব কি গবেষণা হয়েছে? ক’টা গ্রন্থ লেখা হয়েছে? বহু ঘটনা, ইতিহাস অজানাই থেকে গেছে আমাদের জানার বাইরে। এশিয়ার ক’টা বিশ্ববিদ্যালয়ে এইসব ইতিহাস পড়ানো হয়েছে আমার জানা নেই। আদৌ কি হয়েছে? জাপানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই এই বিষয়ে কোনো শিক্ষা দেয়া হয়নি, হয় না। ভারতেও হয়েছে বা হয় বলে আমার জানা নেই।
‘বঙ্গবন্ধু ও জাপান’ গ্রন্থটি লিখতে গিয়ে অনেক আগে কেনা ‘আজিয়া দোকুরিৎসু এ নো মিচি’ বা ‘এশিয়া: স্বাধীনতা-অভিমুখী পথ’ গ্রন্থটি পড়ে সেই ঘটনাসমূহ ও ইতিহাস জানতে পারছি। লেখক তানাকা মাসাআকি, ১৯১১ সালে জন্ম জাপানি সাংবাদিক, লেখক, গবেষক এবং প্যান-এশিয়ানিস্ট। পরবর্তীকালে বিশিষ্ট রাজনৈতিক শিক্ষক। তিনি এশিয়ার বারুদগন্ধী, লড়াইমুখর আর উন্মাতাল ঘটনাসমূহের সাক্ষী।রবীন্দ্রনাথ, বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, নেতাজি, এম এম নায়ার, এম এম সাহাই, গান্ধী, বা মো, চিয়াং কাই-শেক, মাহাথির, নেহরু, বিচারপতি পাল প্রমুখের জীবিতকালের মানুষ। পরিণত বয়সে বঙ্গবন্ধু এবং ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেছেন একাধিকবার। প্রত্যক্ষ করেছেন যুদ্ধবিগ্রহ। গুঁড়ি গুঁড়ি অক্ষরে তথ্যেঠাসা ৩৫০ পৃষ্ঠার এই ইতিহাস গ্রন্থটি একটি বাইবেল বললে অত্যুক্তি হয় না। এমন আর কোনো দ্বিতীয় গ্রন্থ নেই জাপানি ভাষায়। এই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর কথাও আছে।