ইমরান ফুটওভারে দাঁড়িয়ে কিছু সময় রাস্তায় গাড়ির আসা যাওয়া দেখে। ফুটওভারের দুইপাশে যেখানে বাস থামে সেখানে গাড়ি শূণ্য আর হয় না। একটা না যেতে আরেকটা বাস এসে থামে। বাস এসে থামার সাথে সাথে বাসে উঠার জন্য যাত্রীরাও হুমরী খেয়ে পরে। কোন একটা বাস এসে থামলে যাত্রীদেরও যেন ধৈর্য ধরার সময় হয় না, কার আগে কে গিয়ে উঠবে বাসে সেই প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হয়ে উঠে সবাই। ইমরান খেয়াল করে সেখানে বাস এসে থামলে থেকে থেকে কয়েকজন লোক ড্রাইভারদের কাছ থেকে অতি সতর্কতার সাথে ধারাবাহিকভাবে হাতের মুঠোয় টাকা নিয়ে পুলিশ সার্জেন্টের কাছে নিয়ে পৌছে দিচ্ছে। ইমরান এসব দেখে তার ইচ্ছে হয় ওদের হাতেনাতে গিয়ে ধরতে। আবার ভাবে ধরলে হবে কি? ধরে যেই পুলিশকে বলবে সেই পুলিশইতো নিচ্ছে টাকা। সমাধান হবে না কোন।
ইমরান সেখানে দাঁড়িয়ে বিষয়টি দেখে আর হিসাব করে এই একজন পুলিশ সার্জেন্ট চাইলে উক্ত এলাকার পুরো চেহারা বদলে দিতে পারে। লাইন ধরিয়ে গাড়ি গুলো চলার ব্যবস্থা করে যাত্রী সেবায় সুযোগ করে দিতে পারে অথচ তা না করে উল্টো কিছু টাকার জন্য যেন অনিয়ম সৃষ্টিই করছে পুলিশ সার্জেন্টটি। এসব দেখে নিজের ভিতর এক ধরনের সচেতনতা বোধ সৃষ্টি হতে শুরু করে আর নিজের সাথে নিজেই যেন যুদ্ধ শুরু করে। ভাবে, এর পরিবর্তন ঘটানো যায় কি করে। ভাবে আর ফুটওভারের উপর পুবদিক থেকে পশ্চিমদিকে কয়েকবার আসে যায় আর নীচে গাড়ি চলাচলে অনিয়ম লক্ষ করে।
সেখানে সে একটা গ্রুপ করার কথা ভাবে। সাধারণ পথযাত্রীদের কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে পাশের কোন এক চায়ের দোকানে বসে চা খাবে। চা খেতে খেতে প্রসঙ্গ তুলবে এই এয়ারপোর্ট এলাকা কি করে নিজেদের উদ্যোগে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখা যায়। কি করে পুলিশদের চাঁদা উত্তোলন থেকে মুক্ত করা যায় পুরো এই এলাকা। এতে প্রথমে কেউ তাকে পাত্তা না দিলেও একসময় তার কথায় কেউ না কেউ সাড়া দিবে। একজনও যদি সাড়া দেয় তাকে নিয়েই শুরু করবে তার মিশন।
মনে মনে আইডিয়া করে, ফুটওভার ময়লায় স্তুপ পড়েছে। কোন এক শুক্রবার এসে এই ফুটওভারটি পরিষ্কার করবে। এরপর এয়ারপোর্ট থেকে বড় রাস্তায় আসার যে সরু ফুটপাত সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনবে। এরপর করবে বিমানবন্দর রেল স্টেশনটিকে ফেরিওয়ালা মুক্ত। আবার ভাবে এই এলাকার চাঁদা অবশ্যই কেবল পুলিশের হাতে যায় না। পুরো ঢাকা শহর যেখানে ফেরিওয়ালাদের দখলে সেখানে বিষয়টিকে সে সহজে ভাবলে চলে না। অনেক উপর পর্যন্ত এর কমিশন যেতে পারে, তখন তার কাজের পথ সুগম না হয়ে হতে পারে ঝামেলা পূর্ণ।
বিমানবন্দরে সে এর আগে অনেকবার এসেছে। এটুকু পথেই সে নিজের পকেট থেকে মানিব্যাগ হারিয়েছে। নিজের চোখে ছিনতাইকারীদের অন্যের হাত থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালানোর দৃশ্যও দেখেছে। যে কারণে আজ হঠাৎ করে তার মিরাজ আংকেলের সাথে দেখা হয়ে যাবার পর দাঁড়িয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করে। ফুটওভার থেকে নেমে স্টেশনের সামনে গিয়ে ফেরিওয়ালা এবং ছোট গাড়িতে করে ফেরিকরাদের সাথে সহজ ভাবে এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। কথায় কথায় সে জানতে পারে প্রতিটি স্পেস থেকে পুলিশ এবং সরকারী দলের নেতা কর্মীরা প্রতিদিন চাঁদা তোলে। চাঁদা না দিলে এখানে তাদের দাঁড়ানোই সম্ভব না। চাঁদার পরিমান জানতে চাইলে বলে, প্রতিটি দোকানের জন্য দৈনিক তাদের দেড় হাজার টাকা দিতে হয়।
ইমরান হিসেব করে, একদিনে একটি দোকানের জন্য ভাড়া যদি দিতে হয় দেড় হাজার টাকা তাহলে ত্রিশ দিনের জন্য পয়তাল্লিশ হাজার দিতে হয়। এরপর শুধু স্টেশনের সামনেই সে গুনে দেখে পনরটির উপর বিভিন্ন আইটেমের দোকান রয়েছে। মোবাইল বের করে একা একা হিসেব করে। হিসেব করে টাকার অংক লিখে ভাবে, তার মিরাজ আংকেল যেহেতু এই এলাকাতেই থাকেন তাই তার সাথে বিষয়টি আলাপ করলে ভালো হয়। তার আংকেল যেহেতু বিদেশে ছিলেন সুতরাং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞতা রাখেন। ইমরান শুনেছে বিদেশে রাস্তাঘাট অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং এসব স্থানীয় লোকজনই নিজেদের উদ্যোগে রক্ষণাবেক্ষণ করে। ইমরান তার বাবার মুখে শুনেছে। মিরাজ আংকেলকে বললে পর রাজী হবেন হয়তো। তাই তার সাথেই প্রথম শেয়ার করার কথা ভাবে সে।
বাসায় ফিরে তার তেমন জরুরী কোন কাজ নেই আজ। বাবার বিদায় কালে গ্রামের বাড়ি থেকে তাদের বাসায় কিছু আত্মীয় মেহমান এসেছেন। লোকজনে বাসা ভর্তি তাই বাসায় ফিরে তেমন সুবিধা হবে না মনে করে তিনটি জায়গাকে নির্ধারণ করে মোবাইলের মধ্যে নোট প্যাড খুলে নোট করতে শুরু করে তার আইডিয়া গুলো। থেকে থেকে মোবাইলে ছবি ধারণ করে চারিপাশের। কখনও কখনও বড় রাস্তায় যে লোক গুলো বাস চালকের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে হাত বাড়িয়ে, দূর থেকে মোবাইলে জুম করে তাদের ছবিও তুলতে শুরু করে। পরে ছবি দেখে তাদের চেহারা মিলিয়ে কথা বলবে সে। গোপনে বিষয়টি একাই এগিয়ে নেবার চিন্তা করে এখন। শুরুতে অন্য কাউকে জরালে কাজ নাও এগুতে পারে।
একসময় সে ক্লান্ত হয়ে দূরে রেল গেইটের সামনে একটা ছোট চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। বসে আশে পাশের অনিয়মগুলো চোখের ফ্রেমে ধারণ করে আর ভাবে, সে তার মিরাজ আংকেলকে ছাড়া আর কাউকে বিষয়টি বলবে না। হাতে তার পর্যাপ্ত সময় আছে। মিরাজ আংকেলের সম্মতি নিয়ে নিজেই কাজ শুরু করবে। এজন্য তার কোন মিডিয়ার প্রচার দরকার নেই। কাজ করলে মিডিয়া তাকে একদিন না একদিন খুঁজে নিবে।
এয়ারপোর্ট এলাকায় কাজ করে সফল হলে পরবর্তীতে পুরো ঢাকা শহরের স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এই সচেতনতা বোধ জাগ্রত করে শহরকে সুন্দর ও বাস যোগ্য শহরের আওতায় আনার চেষ্টা করবে। ইমরান বেশ ভাল জানে ঢাকা শহরকে উন্নয়নের রোল মডেল করতে উত্তর দক্ষিণ দুই ভাগে বিভক্ত করে দুই মেয়র নির্বাচন করলেও তারা নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নয়ন ছাড়া শহরবাসীর কোন উন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছেন বা নিলেও সফল হয়েছেন বলে শুনে নি। তাই তাদের এই কাজে সংযুক্ত করলে ফল তাদের থলিতেই যাবে। কাজের কাজ থেমেই থাকবে মাঝ পথে।
একসময় দোকানের একটি ছেলে ইমরানের সামনে এসে প্রশ্ন করে, – আপনি কিছুর অডার দিবেন মামা?
ছেলেটির প্রশ্ন শুনে দুচোখের জুম ছোট করে সামনে চায়ের কেটলিতে স্থির করে বলে, – বেশী চিনি দিয়ে এককাপ চা দে। কাপটা ভাল করে গরম পানিতে ধূয়ে তারপর দিবি, বুঝলি?
ছেলেটি ভিন্ন সুরে আবার প্রশ্ন করে, – মামা কি ডাইল খান নাকী?
ইমরান চোখ বড় করে ছেলেটির দিকে তাকায়। ছেলেটি আমতা আমতা করে বলে, – না মামা এখানে অনেকেই খায় তো তাই কইলাম। লাগবো নি? কইলে চায়ের লগে–
ছেলেটি তার কথা শেষ করে না। ইমরান বলে, – যা, তোকে যা বলেছি তা কর। বলার পর ছেলেটি সামনে থেকে সরে যায়।
(চলবে)