রান্না ঘরে রেডী করা খাবার আনিকা এনে টেবিলের উপর রাখে। ইমরান কোন লজ্জা না করে উঠে বেসিনে হাত মুখ ধুতে যায়। এসে তার বন্ধু মার্টিনকে বলে, – যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো। বলেই সে মারীয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, – তোমরাতো মেহমানদারী করতে করতে নিজেরা না খেয়ে আছ। এক সাথে বসে খেয়ে নেও।
আমি খেয়েছি। মা আর মামী খায় নি।
বসেন তাহলে।
আরে তোমরা খাও। তারা খাইবো নে। মহিলা মানুষ সবার সামনে না খাইলেও সব সময় তাদের পেট ভরা থাকে। রান্না করার সময় রান্না কেমন হয়েছে দেখতে দেখতেই তাদের খাওয়া হয়ে যায়।
মারীয়ার মা বললেন, – তুমি শুরু কর আমরা বসছি। ইমরান আর মার্টিন খেতে শুরু করে। এরমধ্যে মারীয়ার মা আর আনিকা খাবার নিয়ে এসে পাশের চেয়ার টেনে বসেন। মিরাজ কথা তোলেন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। বলেন, – দোকানে ওরা তোমাকে কিছু বলেছে?
না। কাস্টমারদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল। আমি আপনার কথা বলাতে বলল আজকে নাও যেতে পারেন। তাই চলে আসলাম। আমিও আর ওদের সাথে বেশী কিছু বলিনি।
দোকানটা আমি বিদেশ থাকতেই বুকিং দিয়েছিলাম। খেয়ে না খেয়ে এই দোকানটাই রেখেছিলাম। এছাড়া অন্য আর কিছুই করা হয় নি। অনেকসময় কিস্তি দিতে আমার কষ্টও হত। মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করে হলেও কিস্তি দেওয়া ঠিক রেখেছি। তোমার বাবা সবই জানে। এই দোকানটা ছাড়াও ক্যাশ ভালোই নিয়ে এসেছিলাম। প্রথম ভেবেছিলাম টাকাটা ব্যাংকে রেখে দেবো ফিক্সড করে। সেটা থেকে প্রতি মাসে সুদ যা আসে তা দিয়েই সংসার চালাবো। আসার সময় তোমার বাবা আমাকে অনেক না করেছিল আসতে। সবসময় বোঝাতো দেশে গিয়ে সুবিধা করতে না পারলে সমস্যা হবে। তখন চাইলেই আবার ফিরে এসে এত ভাল চাকরী আমি নাও পেতে পারি, তাই।
মারীয়া তার বাবার কথা শুনে চুপ করে থাকে। মনে মনে হয়তো বলছে, বাবা যে কেন অপরিচিত মানুষের সামনে এত সব কথা বলছে। তার বাবাকে সে থামাতে চায়, আবার ভাবে বাবাকে বললে আবার কি বলে ফেলে। বাবা পরিচিত অপরিচিত সবার সাথেই একই কথা সবসময় বলতে থাকেন। থামাতে চেয়েও কিছু বলতে পারে না তাই ভিতরে ভিতরে জলছিল কেবল মারীয়া।
মিরাজ বলছেনই, – দেশে আসার পর এই দোকানের যখন দখল নেই। তখন দোকানের সব টাকা পরিশোধ করা হয়ে গেছে। দোকানের কোন ভাড়া লাগে না। ব্যবসাও এখানে আল্লাহ্র ইচ্ছায় ভালোই হচ্ছে। তবে এই ব্যবসা জমানোর আগে অনেক লোককে বিশ্বাস করে আমি ঠকেছি। বিশ পঁচিশ লাখ টাকা ধরা খেয়ে পাগল হয়ে যাবার পালা হয়ে গিয়েছিল আমার। এমন সময় তোমার আন্টি আমাকে সাহস দিয়ে বলল, মানুষের সাথে কিছু না করে এখানে নিজে কিছু করার চিন্তা করতে।
মারীয়ার মা ক্ষেপে যাবার মত উচ্চ স্বরে বললেন, – হইছে, রাখ এখন এসব আলাপ। সবাইকে সব কথা বলে বেড়াতে হবে না। আমি না করতে বললে তো তুমি এই দোকানটা কিনতে না।
মিরাজ হাসতে হাসতে বলেন, – সে জানি। তুমি ঝুকি নেওয়াতেই তো আমি সাহস করে এই দোকানটা কিনেছি।
তোমার এই দোকান দোকান করে প্রথমে কত কথা। কেন এই দোকান? কি হবে দোকান দিয়ে, কে চালাবে? এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কত ঝগড়া।
ইমরান কথার মোড় ঘুড়িয়ে বলে, – কিন্তু আন্টি, আমি যতটা জানি আপনারা আপন খালাতো ভাইবোন। আপনারা দুজনে প্রেম করে আগে থেকে সবকিছু জেনে শুনেই বিয়েটা করেছিলেন। আত্মীয়র মধ্যে বিয়ে করে কেমন লেগেছিল? এখনইবা কেমন লাগছে?
বিয়ের আগের প্রসঙ্গ টেনে বললেন, – সব দোষ তোমার আংকেলের। সে আমাকে একদিন প্রস্তাব দেয়। তারপর কিভাবে যেন আমাকে পটিয়ে ফেলে। ওসব কথা মনে হলে এখন মাঝে মধ্যে মনে হয় কেন বিয়ে করেছিলাম। না করলে ভালো হত। এমনিতে তোমার আংকেল মানুষ খারাপ না। কিন্তু বিয়ের পর বদলে গেছে। বিয়ের পর থেকে দেখছি সে তার ভাইবোনের জন্য খুব বেশী পাগল। কেন যে এত পাগল তা বুঝি না। বিদেশ থাকতেই দেখেছি নিজের ছেলে মেয়েদের চেয়ে তাদের জন্যই যেন বেশী চিন্তা। টাকা তো সে কম রোজগার করেনি। কিন্তু এই টাকা দিয়ে কি করেছে বলতে পারি না।
শেষ দিকে যখন দেখলাম সে দেশে এসে কোন কিছুরই হিসাব মিলাতে পারবে না তখন আমি নিজে সবকিছুতে এগিয়ে গিয়ে টাকা পয়সার ভার নিলাম। তখন যদি হিসাব নিজের হাতে বুঝে না নেই তাহলে আজকে আমাদের আর ঢাকা শহরে থাকা হত না। গ্রামেই সবার সাথে এক বাড়িতে মিলে মিসে থাকতে হত। তোমার আংকেল আমার কোন কথাই শুনতে চায়নি তখন। তার কথা একটাই ছিল, যেভাবেই হোক সবাই মিলে আমরা এক সাথে গ্রামে থাকবো। গ্রামে থাকলে আজকে আর মারীয়াদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হত না। অনেক আগেই হয়তো ওর বিয়ে দিয়ে দিতে হত। আমি জিদ করে ঢাকায় আসার কথা বলেছি। না আসলে তার আজকের এই ব্যবসাও করা হত না।
মিরাজের মুখে সাদা কালো খোচা দাঁড়ি। দুই হাতে দুই গাল ধরে দাঁড়িতে হাত বোলানোর মত ঘষতে ঘষতে মুখের দুই ঠোঁট ফাঁক করে। দেখে মনে হয় কিছু বলবেন। ইমরান তার মুখের দিকে তাকালে বলেন, – আমি বিদেশে থাকতে সে আমাকে কোনদিন কিছু খুলে বলে নি। আমি বুঝবো কি করে, তার ভিতরে কি আছে? পরিকল্পনার কথা খুলে না বললে তো আর বোঝার উপায় নাই, কি বলো তুমি? ইমরানকে প্রশ্ন করেন।
আনিকা কথা ঘুরিয়ে মারীয়াকে বলে, – এই তুমি এক কাজ করো। মারীয়া আনিকার দিকে তাকায়। – আমরা ভাত খেতে খেতে তুমি চা বানাও।
মার্টিন প্রশ্ন করে, – এটা কি বিয়ের আগে রান্না শেখানো হচ্ছে নাকী?
আরে আজ কালকার মেয়েরা রান্না করবে কি? বিউটি পার্লারে গিয়ে পরে থাকে বেশী। রূপচর্চা নিয়ে সময় ব্যয় করে, কাজের কাজ কিছুই করে না। মিরাজ বলতে থাকলে তার মুখ থেকে কথা টেনে নিয়ে মারীয়ার মা বলেন, – যুগ বদলেছে। আগে আমরা ঘরে বসে হাতের কাজ, সেলাই করা আরো কত কিছু করা শিখেছি। এখনকার মেয়েরা তো বাবা মার হোটেলে খেয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারলেই নিজেদের অনেক যোগ্য মনে করে।
আনিকা সুযোগ খুঁছিল তাদের মাঝখানে কথা বলার, সুযোগ না পেয়ে চুপ করে খেয়ে উঠে মারীয়ার সাথে চা বানানোয় সহযোগিতা করে। মার্টিন আনিকার দিকে তাকিয়ে বলে, – আপনাকে দেখে তো মনেই হয় না আপনার যে বিয়ে হয়েছে। তা সাহেব থাকে কোথায়?
আমার সাহেব মানে আপনার কি হয়?
সে যাই হোক, কোথায় থাকে? ঢাকাতে নাকী গ্রামে?
ও তো দুবাই থাকে।
-কতদিন পরপর আসে?
দুইবছর আগে একবার এসিেছল।
দুইবছরে কেউ আর আপনার সাহেবের কাছ থেকেও আসেনি?
আনিকাকে উদ্দেশ্য করে মার্টিনের এমন প্রশ্নের অর্থ কেউ বোঝেনি। সবাই প্রশ্ন শুনলেও অর্থ না বুঝে চুপ করে থাকে। মারীয়া চা এনে টেবিলে রাখে। ইমরান আর মার্টিন ভাত খেয়ে প্লেট মারীয়ার হাতে তুলে দিয়ে দু’জন এক সাথে বেসিনের কাছে যায়। ইমরান হাত ধুইতে থাকলে পাশে দাঁড়িয়ে মার্টিন বলে, – আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না যে আপনি বিয়ে হয়েছেন বা স্বামী আছে।
ইমরান ধমক দিয়ে বলে, – এই, তুমি কি আনিকার প্রেমে পড়লে নাকী আবার? এমন করে বলছো, মনে হয় যেন তুমি কত আপন তার। সে যে তোমার মামী হয় সেটাও কি আবার ভুলে গেছ নাকী? থেমে আবার বলে, – আমি দেখেই বুঝতে পারছি সে যে বিবাহিতা। মামী, আমি কিন্তু মিথ্যা বলছি না। তবে মনে হয়নি স্বামী যে বাইরে থাকে। আপনাকে দেখে মনে হয় আপনার স্বামী আপনার সাথেই থাকে।
ইমরানের কথা শুনে মারীয়ার মা আনিকার দিকে চোখ বড় করে তাকান।
(চলবে) —–