ইমরান বাসে চড়ার আগে সে দিনের সেই চায়ের দোকানে একবার ঢুকে নাহিদের খোঁজ করে। তখন পর্যন্ত নাহিদ আসেনি। চা ওয়ালাকে তার অন্যএকদিন আবার আসার কথা জানিয়ে বিদায় হয়। চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে সামনে যেতে সেই পাঠাওয়ের বেশ কিছু মটরসাইকেল চালকের জমায়েত দেখে ইমরান বলে, – দোস্ত চলো বাইকে চলে যাই। তুমি একটাতে চড়ো, আমি চড়ি আরেকটাতে। খরচ এবং সময় দুটোই বাঁচবে।
মার্টিন বলে, – তুমি যেতেই যদি চাও তাহলে মোবাইলে এ্যাপস থাকলে কল দেও। এখান থেকে এভাবে নেওয়া ঠিক হবে না। কেন? সামনেই এখানে আছে যেহেতু কল দিতে হবে কেন আবার?
এখান থেকে ওদের নিয়ে গেলে যে ভাড়া পাবে ওরা সেটা আর প্রতিষ্ঠানকে দিবে না। পুরোটাই নিজের পকেটে রেখে দিবে। তা ছাড়া এ্যাপস দিয়ে কল দেবার পর যেটি আসবে সেটাতে চড়ে গেলে সেটি নিরাপদ হবে। অফিসে সেটার রেকর্ড থাকবে। মাঝ পথে তোমার কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ওরা অন্তত জানতে পারবে কোন বাইকে কোথা থেকে চড়েছ, ডেস্টিনেশন ছিল কোথায়। তা না হলে তো ওরা অন্য কোথাও নিয়ে চলে যেতে পারে। অন্য কোথাও নিয়ে গেলে অফিস আর সেটা জানতেও পারবে না। আজকাল কিন্তু বিভিন্ন দুর্ঘটনার সংবাদ আসছে মিডিয়াতে। তাই ওদের এভয়েড করা ভাল।
মার্টিনের কথা শুনে ইমরান বলে, আসলে ওরা দেখছি রিক্সার চেয়ে খারাপ হয়ে উঠছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে দল বেধে আর রাস্তার ধারে পথচারী যেতে দেখলে তাদের পিছে লাগে। জানতে চায় কোথায় যাবে। বললে পর মুখে মুখে ভাড়া ঠিক করে তুলে নিয়ে যায়। তুমি আসলে যেভাবে চিন্তা করেছ, আমি সেভাবে কখনেও ভাবি নি।
ওদের দু’জনের কথা একজন বাইক চালক শুনে বলে, – ভাই, সবাই কি আর এক নাকী? কোথায় যাবেন, আসেন নিয়ে যাই। আপনাকে এ্যাপসে ভাড়া দেখিয়ে নিয়ে যাবো। একটাকাও এদিক সেদিক হবে না।
মার্টিন তার উত্তর দেয়, – আপনার ভাড়া কম বেশী নেবার কথা বলা হয় নি। আমরা আলোচনা করছি, আপনারা যে এই ভাড়া দেখিয়ে নিবেন সেটি তো আর এ্যাপসে এড হবে না। আর এ্যাপসে এড না হলে অফিস তো এই টাকাটা পাবে না। এটা আপনাদের ভিন্ন কৌশল যাত্রীদের সাথে ভাড়া নিয়ে কোন খেচ খেচ না করে প্রতিষ্ঠানকে ঠকানোর।
লোকটি তাদের কথা শুনে কিছুটা বিব্রত হয়। উত্তর করতে না পেরে আবার প্রশ্ন করেন, – যাবেন? গেলে উঠেন। কোথায় যাবেন?
মার্টিন ইমরানকে বলে, – আমার মোবাইলে এ্যপস ডাউন লোড করা নেই। তুমি কল দেও। তখন ওদর কেউ না কেউ কল করবে। কল করলে পর না হয় যেয়ো। বলেই আবার বলে, – এই শোন, কাছেই বাস স্ট্যান্ড চলো বাসে চলে যাই। সামনে গিয়ে টিকিট করে বাসে সিট নিয়ে যাওয়া যাবে। বি আর টি সি বাসে গেলে একবারে তোমার খেজুর বাগান মোড়ে গিয়ে নামিয়ে দিবে। সেখান থেকে তোমার বাসা তো কাছেই।
ইমরান বলে, – চলো তাহলে বাসে যাওয়া যাক। বলে বড় সড়কের দিকে হাটতে থাকে এমন সময় ফোন আসে মারীয়ার। ইমরানের মোবাইলে মারীয়ার নাম্বার নেই। ইচ্ছে করেই নাম্বার চেয়ে নেয় নি সে। কল আসলে কোন নাম শো না করাতে ফোন রিসিভ করেই প্রশ্ন করে, – হ্যালো কে?
ভাইয়া, আমি মারীয়া।
কি মারীয়া, কোন কিছু কি ভুলে রেখে এসেছি নাকী?
টেবিলের উপর একটা কাগজের প্যাকেট, এটা কি আপনার নাকী মেহমান এসেছিল যে তাদের শিউর হতে ফোন করেছি।
আমার না। আমার সাথে যে ছিল তার হাতেও কোন প্যাকেট ছিল না। তারপরেও লাইনে থাকো আমি জিজ্ঞেস করে নেই তারপর বলছি।
মারীয়াকে লাইনে রেখে মার্টিনকে জিজ্ঞেস করে সে, বাসায় কোন প্যাকেট ভুলে ফেলে রেখে এসেছে কি না। সে না করলে মারীয়াকে বলে, – আমাদের না। হয়তো মেহমানদের কারো হতে পারে। বলার পর, মারীয়া বলে, – ঠিক আছে তাহলে। আর শোনেন আমার মোবাইল নাম্বার এটা, সেভ করে রাইখেন।
ফোন কেটে মার্টিনকে বলে, – মারীয়া ফোন করেছিল।
আমি জানতাম এমনই যে কিছু একটা ঘটনা ঘটবে। কিন্তু আমার চোখে যে আনিকাকে লেগে আছে। তাদের দেশের বাড়ি কোথায়?
আমার মনে হয় বরিশাল। কথা শুনে তো আমার কাছে তাই মনে হয়।
তোর মিরাজ আংকেলদের বাড়ি?
পদ্মার ওপারে।
পদ্মার উপারে বলতে? পদ্মা কি তোমার চিন্তার মত ছোট নদী নাকী। দেশের বহু এলাকা নিয়ে এই পদ্মা নদী।
হাটতে হাটতে বিমান বন্দর রেল স্টেশনের উত্তর দিকে গিয়ে রাস্তার উপর ছোট একটা টেবিল নিয়ে বসা একটি ছেলে বিভিন্ন বাসের টিকিট সাজিয়ে নিয়ে বসা। সে তাকিয়ে আছে রাস্তার পথচারীদের দিকে। ছেলেটির মাথার উপর বিশাল বড় এক ছাতা। মুখে একটা রুমাল অর্ধেক ভাজ করে মুখের উপর দিয়ে নিয়ে পিছন দিকে টেনে বেধে রেখেছে। একটার পর একাট দূর পাল্লার বাস আসছে। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে আবার ছুটে চলে ঢাকা শহরের দিকে। ছেলোটর কোন কিছুতে তাড়া নেই। টিকিট কাটার কোন ভিড়ও নেই কারো মধ্যে। থেকে থেকে দু’একজন হয়তো টিকিট কেটে বাসের জন্য অপেক্ষা করে। বাস আসলে যাত্রী উঠে সিটে নিয়ে বসে।
ইমরান সামনে গিয়ে বি আর টি সির দু’টা টিকিট চেয়ে নেয়। দুটো টিকিটের ভাড়া একশ টাকা। ইমরানই টাকা দিয়ে সুবিধা মত খালি জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। থেকে থেকে এদিক সেদিক তাদের সরে দাঁড়াতে হয়। বাস এমন ভাবে এসে থামে মনে হয় পারলে অপেক্ষমান যাত্রী বা পথচারীদের উপর তুলে দিবে।
বাসের এমন উল্টা পাল্টা গতিতে বাস এসে স্ট্যান্ডের সামনে থামানোয় ইমরান বলে, – ওদের এই যে দানবের মত গাড়ি চালানো, একদম হুশ নেই যেন। পথচারীরা একটু অমনযোগী হলেই তাদের উপর যেন বাস তুলে দিবে। ওদের কাছে মানুষের জীবনের কোনই দাম নেই যেন।
-ওদের এমন করে গাড়ি চালানোর কারণে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে যত্রতত্র পথচারীদের জীবন যাচ্ছে। এসবের দিকে কারোই কোন নজর নেই। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের অচল গাড়ি রাস্তায় চালানোয় কোন বাধা দেয় না। দালালের মাধম্যে কোন ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া যাকে তাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছে। বি আর টি এ-র কর্মকর্তাদের এসব নিয়ে কোন ধরনের মাথা ব্যথা নেই। এসব নিয়ে আন্দোলন করলে দেখা যায় পরিবহন সমিতির লোকজন উল্টো হরতাল ডাকে। মালিক বা চালক কেউই কোন নিয়ম নীতি মানছে না। ওরা যেন মগের মুল্লুক পাইছে সব।
একটা দোতলা বি আর টি সি বাস এসে সামনে থামলে সামনে কিছু লোক দাঁড়ানো ছিল ওদের বেশীর ভাগ দৌঁড়ে গিয়ে বাসে উঠে। ইমরান আস্তে ধীরে পিছন দিক দিয়ে উঠে উপরে চলে যায়। তার দেখা দেখি মার্টিনও উপরে উঠে যায়। উপরে তখনও কিছু সিট খালি দেখে দু’জন আলাদা সিটে বসে। মধ্যবয়সী একজন যাত্রী তাদের দু’জনকে এক সাথে বুঝতে পেরে সে উঠে দু’জনকে এক সাথে পাশাপাশি বসার ব্যবস্থা করে দেন। ইমরান এবং মার্টিন দু’জনই লোকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে উঠে এক সিটে পাশাপাশি বসে।
উপর থেকে এয়ারপোর্টের প্রবেশ পথ স্পষ্ট দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে দেখছিল ইমরান। একটু পর বাস চলতে শুরু করলে দোতলা বাসের উপর বসে উল্টো দিকে রাস্তার গাড়ি গুলোর দিকে ইমরান তাকিয়ে দেখে। বাস চলতে শুরু করলে ইমরান মনে করে মারীয়ার মোবাইল নাম্বার এখনই সেভ না করলে পরে হয়তো ভুলেও যেতে পারে সে। তাই বাসের গতি বাড়ানোর সাথে সাথে ইমরান পকেট থেকে তার মোবাইল বের করে মারীয়ার নাম্বার সেভ করে। সেভ করার সময় মারীয়া নাম লিখে পাশে ছোট একটা লাল হার্ট দিয়ে সেভ করে। এরপর মোবাইল হাতে নিয়ে একটু পরপর মারীয়ার নাম্বার দেখে আর ভাবে, রাতে বাসায় গিয়ে একাকী সে মারীয়াকে ফোন দিয়ে কথা বলবে। এখন ইমরানের মাথায় এক মারীয়ার চিন্তা ছাড়া আর কিছুই আসে না।
এক সময় বাস দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে। ইমরান চুপ করে বাইরের দৃশ্য দেখে আর বুকে বাইরের বাতাস লাগিয়ে নিজেকে সিনেমার হিরো ভাবে।
(চলবে) —–