ইমরান বসেই চা ওয়ালার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবার চায়ের কথা বলে। লোকটি ইমরানের দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে তার নিজের কাজে মন দেয়। সামনে অনেক গুলো রাইড শেয়ারের মটরসাইকেল এসে জড়ো হয়। মূহুর্তের মধ্যে দশ বারজনের একটা গ্রুপ এসে জড়ো হলে ইমরান ওদের দিকে তাকিয়ে দেখে। সবাই ওদের বাইক থেকে নেমে মাথার হেলমেট খুলে সামনে তেলের টাংকী বা গ্লাসের উপর রেখে মোবাইল ঘাটতে শুরু করে।
একটু পরেই একজন সার্জেন্ট এসে সেখানে ওদের সাথে হাত মেলাতে মেলাতে নিজের মাথার হেলমেট খুলে এক হাতে উপুর করে ওদের সামনে ধরে। উপুর করে ধরলে একজন তার হাতের মোবাইল সেটটি সেখানে ভরে দেয়। দেখে মনে হয় তাদের মধ্যে বেশ জানাশোনা ভালো সম্পর্ক। ইমরান বিষয়টি দেখে তার মোবাইলে ভিডিও করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এমন সময় দোকানের ছেলেটি তার সামনে এসে টেবিলের উপর চায়ের কাপ রেখে বলে, – মামা, আপনি বুঝি ওদের ভিডিও করবেন?
ইমরান ছেলেটির কথায় এবার কিছুটা বিরক্ত হয়। মনে মনে ভাবে, এই পুস্কে ছেলেটা বুঝলো কি করে সে যে এখানে বসে ওদের বিষয়টি ভিডিও করার কথা ভাবছে? নিজের মোবাইল সেট টেবিলের উপর রেখে চায়ের কাপ হাতে নেয়। মুখে দেবার আগে প্রশ্ন করে, – চিনি বেশী দিয়েছিস তো?আগে খাইয়া দেখেন, কম হইলে চিনির বইয়ম এনে দিমু। মামা কি সাংবাদিক নিহি?
ইমরান মুখে চা নেয়। মুখে চা নিয়ে মুখ একটু ভেংচিয়ে বলে, – তুই তো চা একদম সিরাপ বানিয়ে ফেলেছিস রে? এত মিষ্টি চা খায় মানুষ?
ছেলেটি শরীর বাকা করে মুখে হাসি টেনে বলে, – আপনি থাকেন কই মামা? এর আগে তো আপনেরে এই এলাকায় কোনদিন দেহি নাই।
তোর নাম কিরে?
নাহিদ।
বাড়ি কই তোর?
আমগো বাড়িঘর নাই।
নাই মানে?
আগে আছিল। নদীতে সব ভাইংগা ভাসাইয়া লইয়া গেছে গা।
কথার মাঝে ইমরান সামনের বাইক চালকদের সাথে পুলিশ সার্জেন্টের কথা বলা আর হেলমেট নিয়ে সামনে ধরার বিষয়টি খেয়াল করে। ওদের দেখেই বুঝতে পারে ওরা এখানে দিতে এসেছে আর সার্জেন্টও যে নিতে এসেছে। কিন্তু বিষয়টি গোপনে মোবাইলে ধারন করতে পারলে পরবর্তীতে ফেইসবুকে শেয়ার দিতে পারবে। ভাবলেও চায়ের দোকানের এই ছেলেটিকে তার ভয়। ছেলেটি যদি আবার ওদের কারো ইনফর্মার হয়ে থাকে তাহলে বলে দিবে। বলে দিলেই সমস্যা হবে। ইমরান ওকে কিছু বলার আগে ছেলেটিই নিজে থেকে বলতে থাকে। তার সম্পর্কে।
মামা, আপনি কি কোন রিপোট করবেন? করলে সন্ধ্যার পর আইসেন। তখন আইলে আরো অনেক কিছু দেখতে পাবেন। এখানে ডাইল খায় দল বাইন্দা। ছিনতাইকারীদের মাল বেচা কেনা হয়।
চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে আর চায়ের দিকে তার নজর নেই। গরম চায়ের বাস্প উড়তে উড়তে একসময় বাষ্প উড়া নাই হয়ে যায়। ইমরান তার মোবাইল ফোন নিয়ে ছেলেটির সামনেই টিপে টিপে ভিডিও অন করে। দূর থেকে ততটা পরিষ্কার ভিডিও করতে পারছিল না। ইমরানকে সহযোগিতা করতে নাহিদ বলল, – মামা আপনি আমারে খালি কন আমি সুন্দর কইরা ভিডিও কইরা দেই। ওরা কেউ টের পাইবো না।
ছেলেটির কথায় এবার ইমরানের বিশ্বাস হয়। মনে করে সে এই এলাকার অনেক তথ্যই ওর মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারবে। এবার মোবাইল অন করা অবস্থায় ওর হাতে দিয়ে নিজে কোন কিছু জানে না এমন ভাব করে চা খেতে থাকে। এরপর পকেটে রাখা মিরাজের দেওয়া তার দোকানের কার্ডটি পকেট থেকে বের করে একবার দেখে। কার্ড দেখে ইমরান বুঝতে পারে না তার আংকেল মিরাজের ব্যবসার আসলে ধরন কি।
একবার ভাবে এখনই ফোন দিয়ে জেনে নিবে তার ওখানে কিসের ব্যবসা। ভুল করে পকেট থেকে মোবাইল বের করতে পকেটে হাত দেয়। মনের ভুলে পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল না পেয়ে চমকে উঠার মত করে। পরোক্ষণেই মনে পড়ে চায়ের দোকানের ছেলেটির হাতে তার মোবাইল। তাই ওর দিকে একবার তাকিয়ে ওর ভিডিও করা দেখে কার্ডটি আবার পকেটে ভরে রাখে।
হেলমেটে কয়েকজন হাত বাড়িয়ে কিছু ভরে দেয় সেটা লক্ষ করে ইমরান নাহিদকে ডাকে। নাহিদ তার মোবাইল অন করা অবস্থায় মোবাইল এনে ইমরানের হাতে দিয়ে প্রশ্ন করে, – এই ভিডিও ফেইসবুকে দিবেন বুঝি? আপনার ফেইসবুক আইডি আমাকে দিলে আমি এটা শেয়ার করতে পারুম।
একবার ইমরানের ইচ্ছে হয় বলতে, – তুই আবার ফেইসবুকও চালাস? কিন্তু প্রশ্নটি সে করে না। নাহিদের হাতে চায়ের বিল দিয়ে বলে, – বাকী টাকা ফেরত দিতে হবে না। তুই রেখে দে। বলে সে উঠে দাঁড়ায়।
নাহিদ বিল দিয়ে বাকী টাকা নিয়ে এসে ইমরানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, – আপনেরে কেমন জানি আমার কাছে সন্দেহ লাগতাছে। আপনি আসলে কিসে চাকরী করেন? এখানে যে অন্যায় কাজ হয় এসব গোপনে ধরতে আইছেন বুঝি?
ইমরান কোন কথা না বলে নাহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাহিদ আবার বলে, – কয়টারে আপনে ধরবেন। এই এলাকায় যারা এগুলারে ধরার কথা হেরাই করে যত অনিয়ম।
তুই কতটুকু পড়েছিস রে?
বেশী না। ক্লাস ফাইভ।
এখন আর স্কুলে যাস না কে? আমি সুযোগ করে দিলে যাবি স্কুলে?
কিছু সময় চুপ থেকে নাহিদ উত্তর দেয়, – পড়ালেখা করার ইচ্ছা তো আছেই। কিন্তু করুম কেমনে?
ইমরান আবার এসে ওর সাথে গল্প করার ওয়াদা করে দোকান থেকে বিদায় হয়ে একটা রাইড শেয়ার কল দেয়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এত গুলো রাইড শেয়ার থাকা সত্বেও কেউ তার কলে সাড়া দেয় না। অ্যাপস টিপতে থাকে। টিপতে টিপতে দূরে থাকা একজনের কাছ থেকে ফোন কল আসে। জানতে চায় কোথায় যাবে? যদিও সে রিকোয়েস্টে লিখেছে হোয়োর টু-র ঘরে, ফার্মগেইট, তারপরেও জানতে চাইলে ইমরান বলে, – আমি ফার্মগেইট যাবো।
অপর প্রন্ত থেকে কি বলে, নাহিদ তা না শুনলেও ইমরানকে প্রশ্ন করে, – মামা বুঝি ফার্মগেইট থাকেন। আমি আগে কাওরান বাজারে ছিলাম। ওখানে একটা চায়ের দোকানে কাজ করেছি।
নাহিদকে থামিয়ে দিয়ে ইমরান বলে, – আরেকদিন এসে তোর গল্প শুনবো। ভাল থাকিস। বলে দোকান থেকে বাইরে এসে তার মোবাইলে উবারের অ্যাপস আবার ওপেন করে দেখে। সেখানে লেখা রয়েছে রাইড শেয়ারের এসে পৌছতে আর দুই মিনিট বাকী। বড় রাস্তার পাশে গিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করে কোন দিক থেকে আসছে তার কল করা রাইড শেয়ারের মটর সাইকেলটি।
(চলবে…….)