একটি লাল বাইক সামনে কাছেই এসে থামলে ইমরান ইশারা দিয়ে তার কাছে আসতে বলে। বাইক চালক ইমরানের সামনে এসে তার মোবাইলে উবারের এপস ওপেন করে ইমরানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, আপনি মনে হয় কল করেছেন, ফার্মগেইট যাবেন?
আমিই কল করেছি।
আপনার নাম কি ইমরান?
ইমরান তার উত্তর না দিয়ে তার মোবাইল প্যান্টের পকেটে রেখে হেলমেট চেয়ে নেয়। হেলমেট নিয়ে বলে, জি আমি ইমরান। বলেই হেলমেট মাথায় দিতে দিতে বাইকে চড়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। এরপর চায়ের দোকানের দিকে আরেকবার তাকিয়ে নাহিদের চেহারা মনে রাখার জন্য ভালোভাবে ওকে দেখে।
বাইক চালক ইমরানকে উঠে বসার অনুরোধ করে বলে, – শক্ত করে ধরে বইসেন। বলেই তার পিছন দিকে রাখা একটি কালো ব্যাগ সামনের দিকে টেনে এনে বুকের সাথে ঝুলিয়ে নিজে একবার সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শরীর ঝাকিয়ে কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে ঠিক হয়ে বসে। এরপর ইমরান উঠে বসে বাইকে।
চালক পিছন দিকে তাকিয়ে সতর্ক হয়ে সামনে ডান বামের লুকিং গ্লাস ঠিক করে বাইক স্টার্ট দেয়। স্টার্ট দিতেই বাতাসের সাথে প্রতিযোগিতা করে সামনের দিকে এগিয়ে চলে বাইক। ডানে বামে গাড়ি, সব গুলোকে পিছনে ফেলে মূহুর্তের মধ্যে এয়াপোর্ট এলাকা থেকে ইমরানদের বাইক নাই হয়ে যায়।
দুই পাশে সবুজ গাছগাছালী আর ছোট বড় দালান। শাহ্ করে হাইওয়েতে উঠে যায় তাদের বাইক। ইমরান এই বাতাস কেটে সামনে এগোনো টাইটানিক ছবির হিরো ভাবে নিজেকে। ইচ্ছে হয় দুই হাত ছড়িয়ে বুকের সব বুতাম খুলে ভাসতে। দূরে কাকলী পর্যন্ত কোন কথা বলে না ইমরান। কাকলী পেরিয়ে যাবার পর চালকের সাথে তার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। কোথায় থাকে, নাম কি, দেশের বাড়ি কোথায়, পড়ালেখা করেছে কতদূর, বিয়ে করেছে কিনা, কতদিন ধরে বাইক চালাচ্ছে, মাসে গড়ে কতটাকা জমাতে পারে আরো নানা প্রশ্ন।
চালক ইমরানের সব প্রশ্নের উত্তর দিলেও ইমরানকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ সে দেয় না। কথা বলতে বলতে গিয়ে পৌছায় ফার্মগেইট। সেখানে ব্রীজের পূর্ব পাশে নেমে বাইক চালককে তার হিসাব অনুযায়ী টাকা দিয়ে চলে যায় তাদের পরিচিত দোকানে।
সেখানে বিকাল পর্যন্ত সময় কাটিয়ে চলে যায় সে বাসায়। বাসায় গিয়ে মায়ের সাথে তার মিরাজ আংকেলের দেখা হবার কথা বলে। মা তার মিরাজ আংকেলের কথা শুনে আরো উল্লাস প্রকাশ করে। বাড়িতে লোকজন ভরা। সবার সামনেই ইমরানের মা বলছে, – তোর আংকেলকে বললি না বাসায় আসতে? আংকেলের নাম্বার নিয়ে এসেছিস? ইমরান উত্তর দেয়, এনেছি।
ইমরান তার মায়ের কাছে গিয়ে বলে, মা মারীয়াকে কত ছোট দেখেছি, তাই না? ও নাকী এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
তুই তো ওর মতই। ছোট ছিলি, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িস। দেখা করেছিস তুই মারীয়াদের সাথে?
না। আজ যাই নি। বাবাকে বিদায় দিয়ে ফিরে আসার সময় ফুটওভারে দেখা হয়েছে আংকেলের সাথে। আংকেল খুব ব্যস্ত ছিল। বেশী সময় সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারি নি। বলেছি পরে তোমাকে নিয়ে বাসায় যাবো।
তোর নাম্বার দিয়ে আসিস নি? বা আমার নাম্বার?
না তো, আংকেল তোমার নাম্বার চায় নি, আমি কি করে দেবো?
তোর আংকেল মনে হয় আমাদের কথা ভুলে গেছে। আগে তোর আংকেল প্রায় প্রতিদিন ফোন করে আমাদের খোঁজ খবর নিতো। দেশে আসার পর একবার বাসায় এসেছিল। এরপর আর কোনদিন যোগাযোগ করে নি।
আংকেল মনে হয় বেশ ভাল ব্যবসা করছে। দোকানের কার্ড দিয়ে বলল তার দোকানে যেতে।
কথা বলার এক পর্যায়ে ইমরানের মা মনে করে সে ছেলের সাথে মিরাজের বিষয়ে একটু বেশী আগ্রহ দেখিয়ে ফেলছে। ছেলের সাথে এত কিছু আলাপ করা ঠিক না মনে করে অন্য ঘরে চলে যায়। মা চলে গেলে ইমরান তার মিরাজ আংকেলের দোকানের একবার কার্ডটি তার মার হাতে দেবার কথা ভেবে একটু এগিয়ে গিয়ে আবার নিজেই ভালো করে পুরো কার্ডটি দেখে। কার্ডটির মধ্যে যেন সে মারীয়াকে খোঁজতে থাকে। ছবি দেখার মত করে কয়েকবার দেখেমানিব্যাগে যতœ করে ভরে রাখে।
কার্ডটিকে সে মারীয়ার ছবি মনে করে আবার বের করে ছবি দেখার মত করে দেখে আর মনে মনে ভাবে, সামনে ওরা তাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে খ্যাতিমান লেখক হুমায়ূন আহমেদ এর কবর দেয়া স্থান নুহাশ পল্লীতে যাবে পিকনিক করতে। তাদের সাথে মারীয়া আর আন্টিকে দাওয়াত করবে। সাথে গেলে সারাদিন বেশ আনন্দ ফূর্তি করতে পারবে। এজন্য আগেই একদিন তাদের বাসায় যাওয়া দরকার। আগে থেকে না বললে বা আসা যাওয়া করে সম্পর্ক ডেভেলপ না করলে পলে হঠাৎ করে বললে নাও যেতে পারে। তাই সামনে গিয়ে এবার তার মাকে বলে, – আচ্ছা মা, মারীয়াদের কথা কি তোমার মনে আছে?
ইমরানের মুখে বারবার মারীয়ার কথা শুনে তার মা ভিতরে ভিতরে হাসে। মনে মনে মিরাজের টেলিফোনে আলাপ করার কথা মনে করে বলে, – তোর মিরাজ আংকেল তো সবসময় তোর কথাই বলতো। তুই যখন ছোট ছিলি তখন বলতো তোকে দিয়ে মারীয়াকে বদলাবে। আমি বলতাম বদলাবদলির আর দরকার কি, আমি না হয় মারীয়াকে নিয়ে আসবো।
মায়ের মুখে মারীয়াকে নিয়ে এমন কথা বলতে শুনে ইমরান এবার শান্ত হয়। চলে যায় সে বসার ঘরে। সেখানে তার দাদা দাদী বসে টিভি দেখছিলেন। বাসায় লোকজন বেশী বলে ইমরানের যেন গা জ্বালা করতে শুরু করে। এঘর থেকে ওঘর করে শেষ পর্যন্ত বসার ঘরে গিয়ে টিভি রিমোট নিয়ে টিভি চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে যে চ্যানেলে ক্রিকেট খেলা চলছিল সেই চ্যানেলে স্থির করে খেলা দেখতে শুরু করে।
খেলা দেখা শুরু করলে সাময়িকভাবে সে ভুলে যায় মারীয়ার কথা। ভুলে যায় এয়ারপোর্টের সামনে রাস্তা আর স্টেশনের সামনে অনিয়ম নিয়ে তার অতি ভাবনার কথা। একা একাই যেনে টিভির পর্দার সাথে তাল মিলিয়ে চেচিয়ে বলে, ছ-ক-ক্কা। কিম্বা আ-উউ-ট।
(চলবে…….)