মারীয়া ফোন ধরে প্রথমেই বলল, – হ্যাঁলো ভাইয়া! কেমন আছেন?
মারীয়ার এক প্রশ্ন শুনেই ইমরানের শরীর শীতল হয়ে যায়। সে তার কেমন আছেন, প্রশ্নের উত্তর কি দিবে খুঁজে পায় না। সব যেন তাল গোল পাকিয়ে ফেলে। মারীয়া আবার প্রশ্ন করে, – ইমরান ভাইয়া, আপনি এখন কোথায়? আপনি কি আমাদের বাসায় এখন আসবেন? আসলে আমি ঠিকানা বলি লিখেন।তুমি এক কাজ কর। আমার মোবাইলে ঠিকানাটা এস এম এস করে পঠিয়ে দেও।
মারীয়া নরম করে বলে, – এতদিন পর আমাদের কথা আপনার মনে পড়ল? শুনেছি আংকেল এসেছিলেন দেশে, আমাদের সাথে তো যোগাযোগ করলেন না?
মারীয়ার এবারের কথায় ইমরানের মন শান্ত হয়। একটা ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, – তুমি এস এম এস পাঠাও আমি এয়ারপোর্টের কাছেই আছি। রেল ক্রসিংয়ের সামনে।
রেলক্রসিংয়ের উপর দিয়ে লোকজন হেটে পারাপার হয়। সে তাকিয়ে দেখে লোকজনের ধীর স্থির হাটা চলা। দূরে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন। ট্রেনের সামনে সাদা রং দিয়ে বাংলায় বড় করে বি আর লেখা। ট্রেনের ইঞ্জিন আর পিছন দিকে এক দুইটা বগি ছাড়া পুরো ট্রেন আর দেখা যায় না। কার্ব এর মত বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের উপর দিক দিয়ে অল্প ধূয়া বের হতে থাকে। থেকে থেকে কান ফাটা শব্দ করে হর্ণ বাজে ইঞ্জিন থেকে।
রেলের উপর দিয়ে হেটে পারাপার হওয়া লোকদের হাতে মোবাইল ফোন। যে ভাবে তারা হেটে পার হয় দেখে মনে হয় না তাদের মনে কোন ভয়ভীতি কাজ করে। মাঝে মধ্যেই পত্রিকায় সংবাদ আসে, ট্রেনের নীচে কাটা পরে এক যুবকের মৃত্যু। কারণ বলা হয় মোবাইলে কথা বলতে বলতে রেল লাইনের উপর দিয়ে হেটে যাওয়া। ট্রেন হুইসেল দিলেও তারা সেদিকে খেয়াল করে না। কিম্বা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে ট্রেনের নীচে চলে গেছে এক যুবক। এধরনের সংবাদ পত্রিকায় প্রায়ই দেখে ইমরান।
ইমরান সেখানে দাঁড়িয়ে সেই সংবাদের কথা মনে করে। মারীয়া তাকে এস এম এস করে ঠিকানা পাঠানোর কথা বলে ফোন কাটে। এর মধ্যে হাজি ক্যাম্পের দিকে উদ্দেশ্য করে ইমরান আর তার বন্ধু হাটে। এটুকু রাস্তা যেতে খেয়াল করে ফুটপাতের উপর ফেরীওয়ালাদের রাজত্ব। অল্প একটু জায়গা দিয়ে পথচারী হাটাচলা করে। সেই ভীড়ে কোন মেয়ে হাটতে দেখলে অতি উৎসাহী কিছু পথচারী মেয়েটির কাছে ভীড়ে তার গা ঘেষে হাটার চেষ্টা করে। এমন দৃশ্য দেখে ইমরান তার বন্ধুকে বলে, আমাদের দেশে মানুষের মানসিকতার কত করুণ অবস্থা। বলেই সে তার মোবাইল অন করে ভিডিও করার প্রস্তুতি নেয় আর তার বন্ধুকে বলে, – তুমি খেয়াল করো দেখবে এটুকু রাস্তায় কত রকম কুরুচীর মানুষ দেখতে পাবে।
ইমরান মনে করে এখানে তার ফেইসবুকে দেবার মত বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজ পাবে। তাই হাটার মাঝে যেন শিকার খোঁজে। এক দোকানে দাঁড়িয়ে এক মহিলা ফলের দাম করছিল। পরনে তার কালো বুরকা। যতটা পারছে মহিলাটি রাস্তা ছেড়ে দোকানের সাথে ঘেষে ফল দরদাম করার চেষ্টা করছে। একটু পরপর সেখানে হঠাৎ করেই যে জটলার মত হয়ে যায়। ইমরান বুঝতে পারে এখানে তার মোবাইল স্থির করে ধরলে একসময় কিছু ভিডিও করতে পারবে।
একবার খেয়াল করে মহিলা বেশ বিরক্ত হয়ে পথচারীদের দিকে তাকায়। ইমরান এগিয়ে গিয়ে মহিলার পাশে দাঁড়ালে মহিলা প্রথমে ইমরানকে দেখে অন্যদের মত সন্দেহ করে। সন্দেহ করলেও ইমরান মহিলাকে বলে, – আন্টি আপনি নিশ্চিন্তে কেনা কাটা করেন। আমি আপনার পাশে আছি।
অপরিচিত কেউ তাকে আন্টি সম্ভোধন করে যখন নিশ্চিন্তে কেনা কাটা করার কথা বলে তখন মহিলা কিছুটা ভয় পেয়ে তার সাথে থাকা ব্যাগটি ঘুরিয়ে সামনে নিয়ে নিজেকে সাবধান করে। কিছু সময় সেখানে দাঁড়িয়ে পথচারীর ব্যস্ততা দেখে ইমরান সামনে এগিয়ে যায়। একটু সামনে গিয়ে দেখে রাস্তার মোড়ে এক লোক ডাব বিক্রি করছে। সেখানে সাইড হয়ে মোবাইল আবার অন করে দেখে কোন এস এম এস এসেছে কি না। তখনও কোন এস এম এস না আসায় সে ডাব কেনার জন্য ডাব হাতিয়ে ভাল কচি ডাব খুঁজতে থাকে। কয়েকটা ডাব হাতে নিয়ে একটা সামনে এগিয়ে ধরে বলে, – এটা কাটেন। দাম কত?
কয়টা নিবেন? দুইটা দেন।
আপনার জন্য আর দাম কি? সব সময় আপনি ডাব খান এখানে দাম তো জানেনই।
বলেন, দুইটা কত দিতে হবে?
আরেকটা কোনটা দেবো?
সে তার বন্ধুকে আরেকটা ডাব বেছে দেবার জন্য ইশারা করে সে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে। ডাব বিক্রেতা নিজেই আরেকটা যাব বের করে হাতে নিয়ে বলে, – এটা দেই। এটা কচি হবে। পানিও হবে অনেক। এর মধ্যে এক ভদ্রলোক একটা বড় দুই লিটারের মাম পানির খালি বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে সেটা ভরে দিতে। বাসায় তার রোগী আছে। সে আর কোন দাম দর করেনি।
রোগীর কথা শুনে ইমরান ডাব বিক্রেতাকে বলে, তাদের পরে ডাব কেটে দিতে। আগে রোগীর জন্য ডাবের পানি নিতে আসা লোকটিকে বিদায় করতে বলে একটা একশ টাকার নোট সামনে রেখে বলে, – বিশ টাকা ফেরত দিও।
আপনি যদি এই কথা কন তাহলে ডাব বেচাই আমার ছেড়ে দিতে হবে। দুইটা ডাব বেইচা আমার লাভই হবে এই বিশ টাকা। ইমরানদের দুইজনের দুইটা ডাব সে কাটে। কেটে দুইটা স্ট্র ভিতরে ঢুকিয়ে তাদের দিকে দেয়। এরপর একশ টাকার নোট তুলে নিয়ে পকেটে ভরে পরে যেই লোকটি মাম পানির খালি বোতল নিয়ে ডাবের পানি নিতে এসেছে তার জন্য কোন কিছু না বলে ডাব কাটতে থাকে। তিনটা ডাব কেটে এরপর পাশে একটা থলি থেকে নীল চুংগা বের করে। সেটা বোতলের মুখে ঢুকিয়ে ডাবের পানি ঢালে। তিনটা ডাবে তার বোতল পুরোটা ভরেনি। তাই আরেকটা কাটতে বলে লোকটি বলে, – পুরাটা ভরে দেন।
ডাব কাটা দেখে মনে হয় সেখানে কাস্টমারের ভীড় লেগেই আছে। একটু পরপর লোক এসে দাঁড়িয়ে নিজেদের পছন্দের ডাব বেছে বিক্রেতার হাতে তুলে দেয় আর বলে দাম কমিয়ে নিতে। লোকগুলোর কথা শুনে ইমরান বুঝতে পারে এরা তার নিয়মিত কাস্টমার। যে কারণে কেউ আর দরদাম করে না। যারা রাস্তা ঘাটে খাবার পানিকেও নিরাপদ মনে করে না তারাই একটু সুস্থ্য থাকার প্রত্যাশায় এখানে এসে এই ডাব খেয়ে দিনের শেষে ঘরে ফিরে। কেউ আবার বাড়তি দুইটা ডাব কাটিয়ে হাতে করে নিয়ে যায় বাসায় অন্যদের জন্য।
ইমরান ডাবের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া স্ট্র পরিষ্কার করে মুখে দিয়ে চুমুক দেয়, এমন সময় তার মোবাইলে ম্যাছেস আসার শব্দ হয়। এক হাতে ডাব ধরে অন্য হাতে মোবাইল ওপেন করে দেখে। মারীয়ার পাঠানো ম্যাছেজ। দেখে তার ভিতর নেচে উঠে আনন্দে। এই আনন্দের কথা সে তার বন্ধুর সাথে শেয়ার করতে পারে না। হাতে তার ডাব থাকলেও মুখে দেবার শক্তি হারিয়ে ফেলে সে আনন্দে। ঠোঁটের উপর এক চিলতে হাসি খেলিয়ে মারীয়ার কথা ভাবে। ভাবে, মারীয়ার সাথে আজ তার দেখা হবে। দেখা হলে আজই সে বলবে তাকে নিয়ে তাদের ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে অংশ নেবার কথা। নিশ্চয় সে এর আগে কখনও নুহাশ পল্লীতে যায় নি। নুহাশ পল্লীতে যাবার কথা শুনলে মারীয়া খুশীই হবে হয়তো।
মারীয়ার কথা ভেবে সে অন্য সামাজিক কাজের কথা ভুলে যায়। আশে পাশে অটো রিক্সা ওয়ালাদের বাড়াবাড়ি রকম উল্টা সিধা চলাচল দেখে ভিতরে রাগ হলেও মারিয়ার সাথে দেখা হবার আনন্দ সব কিছুকে মলিন করে দেয়।